বাবুল মিয়া, নূরুল হক ও মো. শাহজাহান। শান্তিগঞ্জের হাসনাবাজ গ্রামে কাঁঠালকাণ্ডে সংঘর্ষে দুই পক্ষের নিহত তিন ব্যক্তি তারা। বাবুল মিয়া ও নূরুল হক দ্বীন ইসলাম পক্ষের ও শাহজাহান মালদার আলী পক্ষের। পরে ১০ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাতের প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেন একই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মোখলিছুর রহমান। তিনি গ্রামের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বলে দাবি করে মালদার আলী পক্ষ।
মোখলিছুর রহমানসহ সংঘর্ষের ঘটনায় মালদার আলী পক্ষেে দুইজন নিহত হয়েছেন বলা হলেও মোখলিছুর রহমানের স্ত্রীর দেওয়া এক বক্তব্যে তার মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় তারা তিন জনের মৃত্যুর খবর জানেন। মোখলিছুর রহমানের মৃত্যু এ ঘটনায় ঘটেছে এমনটি দাবি করা হলে পুলিশ লাশের ময়নাতদন্ত করিয়েছে। রিপোর্ট আসার পরেই বলা যাবে মোখলিছুর রহমান সংঘর্ষের ঘটনায় মারা গেছেন নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু।
শনিবার (১৫ জুলাই) দুপুরে হাসনাবাজ গ্রামে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় অন্য এক চিত্র। অন্যান্য বছরের এমন দিনে যে গ্রামের প্রতিটি রাস্তার মোড়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতেন গ্রামবাসী, মানুষে মানুষে হৈ-হুল্লোড় থাকতো গ্রামে সে গ্রামে এখন বিরাজ করছে রাজ্যের নীরবতা। একজন পুরুষ লোকও নেই সমস্ত গ্রামে। অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা। যে ঘরে তালা নেই সে ঘরে বৃদ্ধ মহিলা আর শিশুরা আছেন। পুরুষেরা তো গ্রাম ছেড়েছেনই সাথে সাথে গ্রামের তরুণীদেরকেও বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ। হঠাৎ হঠাৎ এক দু’জন পুরুষ মানুষের দেখা মিললেও তারা অন্য গ্রামের। এ রাস্তা ব্যবহার করে কোথাও যাচ্ছেন, না হয় দুর্দিনে আত্মীয়দের দেখতে এসেছেন। পুলিশ মোতায়ন করা আছে হাসনাবাজ গ্রামে। অপরিচিত কেউ গেলেই পড়ছেন পুলিশি জেরার মুখে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকায় মহিলারা অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বাজার-সদাই করতে পারছেন না অনেকেই। এমন অবস্থায় ভীষণ বিপাকে রয়েছেন হাসনাবাজ গ্রামে বসবাস করা মহিলারা। দারুণ বিভীষিকাময় সময় অতিক্রম করছন তারা।
মায়েদের চোখেমুখে সন্তান হারানোর আহাজারি :
হাসনাবাজ গ্রামে গিয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় সংঘর্ষে নিহত হওয়া তিনজনের মায়েদের সাথে। বয়স্ক এ মানুষগুলোর চোখেমুখে এখন সন্তান হারানোর আহাজারি। তারা সংঘর্ষ বুঝেন না, গ্রাম্য নোংরা রাজনীতিও তাদের ছুঁতে পারে না। তারা শুধু বুঝেন তাদের কলিজা ছেঁড়া ধন আর নেই; আর ফিরে আসবেন না।
বাবুল মিয়া। বয়স পঞ্চাশের বেশি। এক ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। মা সত্তরোর্ধ্ব জোবেদা বেগম চোখে দেখেন না, কানেও শোনেন না। ছেলের জন্য এখনো কান্না থামেনি তার। হৃদয়ে শুধু পুত্র হারানোর হাহাকার। ভাত-পানিও খেতে চান না তিনি। যাকেই কাছে পান তাকেই ধরে বলেন, আমার বাবুল আইসত বাপ? এমন হাহাকার থামছেই না তার।
নূরুল হক। সুন্দরমালা বেগমের সুন্দর বাগানে ৫ ছেলের ২য় ছিলেন তিনি। সাজানো বাগানে প্রাণের ব্যবচ্ছেদ করে সংঘর্ষে নূরুল হকের মৃত্যু! নূরুল হকের ৩ সন্তান। স্ত্রী শামসুন নাহার ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সুন্দরমালা বেগম শুধু আহাজারি করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষের লোকজন যে জায়গায় ফেলে তার কলিজার টুকরাকে ফেলে কুপিয়েছে সে জায়গা দেখিয়ে দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পরছিলেন। স্ত্রী শামসুন নাহার এসে স্বামী হত্যার বিচার চাইলেন। তাদের আহাজারিতে ভারী হতে থাকে হাসনাবাজ গ্রামের আকাশ।
মো. শাহজাহান মিয়া। পাঁচ সন্তানের জনক তিনি। তিন মেয়ের কাউকেই বিয়ে দিয়ে যেতে পারেন নি তিনি। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হলে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে যাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সত্তরোর্ধ্ব মা আমেলা বেগমের ২ ছেলের বড় তিনি। বড় ছেলের এমন মৃত্যুতে শরীর-মনের জোর হারিয়েছেন তিনি। দিনরাত কাঁদতে কাঁদতে এখন আর চোখ দিয়ে পানি আসে না তারা। নিমিষেই তার গোছানো সংসারে আঁধার নেমে আসে। ছেলে হত্যার বিচার চান তিনি। উপযুক্ত শাস্তি চান প্রকৃত দোষীদের।
মোখলিছুর রহমানের স্ত্রী জমিলা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী বয়স্ক, অসুস্থ মানুষ। মারামারির সময় তিনি ঘরে ছিলেন। মারামারির পর তাকে জামলাবাজ পাঠানোর জন্য বাড়ি থেকে বের করে দেই। পথিমধ্যে টমটম থেকে পড়ে যান। কিছুটা আঘাত পেয়েছিলেন। আমরা প্রথমে নোয়াখালী বাজারের একটি ফার্মেসীতে (নেছার আহমদের ফার্মেসী) নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে পরে সুনামগঞ্জ নিয়ে ডাক্তার দেখাইছি। ডাক্তার বলেছেন তার শরীরের একাংশ নাই, স্ট্রোক করতে পারেন। পরে তাকে নিয়ে বাড়িতে আসি। এদিন সন্ধ্যাতেই ৮/৯টার দিকে তিনি মারা যান। গ্রামের মারামারিতে তিনি যাননি।’
তিনি মারামারিতে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে একপক্ষ দাবি করছেন, এ ব্যপারে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিও প্রেসারের রোগী। এতো কথা বলতে পারবো না। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
শান্তিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালেদ চৌধুরী বলেন, আমরা এখনো জানি হাসনাবাজের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩ জন। একজনের ব্যপারে যে দাবি করা হয়েছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি। মোখলিছুর রহমানের লাশ ময়নাতদন্ত করেছি। রিপোর্ট আসলেই বুঝা যাবে এটি মার্ডার নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু। তবে, মোখলিছুর রহমানের পরিবারের তরফ থেকে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।