সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার চাউলধনী হাওরে স্কুলছাত্র সুমেল আহমদ শুকুর ও কৃষক ছরকুম আলী দয়াল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। একই সাথে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চাউলধনী হাওরের সীমানা নির্ধারণে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিরীহ কৃষকদেরকে হয়রানি বন্ধেরও দাবি জানানো হয়।
শনিবার (৮ এপ্রিল) সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে চাউলধনী হাওর ও কৃষক বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে চাউলধনী হাওর ও কৃষক বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের সদস্য ও সুমেল আহমদ শুকুর হত্যা মামলার বাদী ইব্রাহীম আলী সিজিল লিখিত বক্তব্যে বলেন, চাউলধনী হাওরে কৃষকদের জমি ও সরকারি খাস জমির সীমানা নির্ধারণ না করে ওই হাওর লিজ দেওয়া হয় স্থানীয় দশঘর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে। জাল কাগজপত্র ও ভিক্ষুকদের সদস্য করে গঠিত ওই সমিতি চাউলধনী হাওর লিজ নিয়ে স্থানীয় ইসলামপুর গ্রামের সাইফুল আলম ও তার নেতৃত্বে গড়া বাহিনীর কাছে সাব-লিজ দেয়। লিজের শর্ত ভঙ্গ করে হাওর লিজ নেয়ার কারণে বিশ্বনাথ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে পুলিশ মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করে। পরে বাদী রোশন আলী এ ব্যাপারে নারাজি দাখিল করলে আদালত পুনরায় বিষয়টি তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেন পিবিআইকে। সুষ্ঠুভাবে তদন্তপূর্বক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত আদালতের কাছে দাখিলের দাবি এলাকাবাসীর।
ইব্রাহীম আলী সিজিল বলেন, প্রায় দেড় যুগ ধরে সাইফুল বাহিনী হাওর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সাইফুল ও তার বাহিনীর সদস্যরা ২০২১ সালে চাউলধনী হাওরে স্কুলছাত্র সুমেল আহমদ শুকুর ও কৃষক ছরকুম আলী দয়ালকে হত্যা করে।
তিনি বলেন, বিশ্বনাথ থানার প্রাক্তন ওসি শামীম মুসা, সমবায় কর্মকর্তা কৃষ্ণা রাণী তালুকদার, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম ভুইয়াসহ সরকারি এসব দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সাইফুল ও তার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে, ঘটায় একের পর এক অপকর্ম।
স্থানীয় চৈতনগর গ্রামের সিজিল বলেন, সাইফুল আলম ও তার বাহিনীর হাতে রয়েছে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি চাউলধনী হাওরে তাদের হামলায় প্রাণ হারান কৃষক ছরকুম আলী। একই বছরের ১ মে সাইফুল ও তার লোকজন জোরপূর্বক আমাদের জমিতে মাটি কাটা শুরু করে। এ সংবাদ পেয়ে সেখানে গেলে সাইফুলের নেতৃত্বে গুলি চালানো হয়। গুলিতে স্কুলছাত্র সুমেল আহমদ শুকুর, তার বাবা মানিক মিয়াসহ ৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাদেরকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমেলকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় সাইফুল আলমসহ ৩২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আদালত থেকে জামিন পেয়ে ৩১ জন আসামি বের হয়ে আসে।
সিজিল বলেন, সুমেল হত্যা মামলাটি সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় সাইফুল আলম জামিনের জন্য উচ্চ আদালত পর্যন্ত বারবার আবেদন জানালেও বিচারক তার আবেদন নামঞ্জুর করেন। তবে ৩১ জন আসামি জামিন পাওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া সাইফুলকে জেল থেকে বের করার জন্যও চেষ্টা চালাচ্ছে তার সহযোগীরা। এদিকে, বাদীপক্ষ আদালতের দেওয়া সময়মতো সাক্ষ্য দেয়ার জন্য হাজির হলেও আসামিপক্ষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপন করছে। চলতি বছরের ৩০ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের পূর্বনির্ধারিত তারিখ থাকলেও সাইফুলকে বিচারকের সামনে নেওয়া হয়নি। উল্টো পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের সহযোগিতায় তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিচারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে সুস্থ সাইফুলকে কখনও হার্টের রোগী, আবার কখনও পাগল সাজানো হচ্ছে। অপরদিকে আসামিরা সাক্ষীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
সুজেল বলেন, হাওরের সীমানা নির্ধারণের জন্য হাওরপাড়ের কৃষকদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ দেন। কিন্তু সাইফুল বাহিনী সংশ্লিষ্ট দফতরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে সীমানা নির্ধারণকাজে বাধা সৃষ্টি করে। হাওরের সীমানা নির্ধারণকাজ ঠিকমতো না হওয়ায় জমির মালিকদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পুনরায় ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে সীমানা জরিপের নির্দেশ দেন। কিন্তু তাতেও এ কাজ হবে কি না কৃষকদের মাঝে সন্দেহ রয়েছে। এমনকি প্রশাসনের একটি চক্র অর্থের বিনিময়ে কৃষকদের ভূমিসহ চাউলধনী হাওর সাইফুল বাহিনী ও ভুয়া মৎস্যজীবী সমিতিকে লিজ দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে সুজেল আসামিদের জামিন বাতিল করে সাইফুল আলমসহ সকল আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাওরের সীমানা নির্ধারণে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, চাউলধনী হাওর ও কৃষক বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক আবুল কালাম, যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফ উল্লাহ সিতাব, নজির উদ্দিন, সামসুদ্দীন, মাওলানা ছমির উদ্দিন, ছরকুম আলী দয়াল হত্যা মামলার বাদী মাহমদ আলী, সুমেল আহমদ শুকুরের মা খয়রুন নেছা, বোন সোমা বেগম প্রমুখ।