চা শ্রমিকদের অবহেলিত জীবনে অন্যতম উৎসব রঙ পরব বা ফাগুয়া উৎসব। তার আবেদন আজ সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে। এটি যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
শনিবার (১১ মার্চ) মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফুলছড়া চা-বাগান মাঠে নানা বয়সি হাজারও নারী-পুরুষ আবির নিয়ে রঙের খেলায় মেতে উঠলে সবুজ চায়ের বাগানের হৃদয় কিছুক্ষণের জন্য হয়ে ওঠে নানা রঙে রক্তিম।
বাংলাদেশের চা-বাগানগুলোতে নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। চা শ্রমিকদের যেমন নিজেদের পৃথক ভাষা আছে, তেমনি আছে পৃথক সংস্কৃতিও। ভাষা ও সংস্কৃতিতে একেকটি চা-বাগান যেন একেকটি দেশ। তবে ফাল্গুনের ‘ফাগুয়া’ উৎসবে এসে সবাই এক হয়ে মেতে ওঠেন রঙের উৎসবে।
দরিদ্র প্ররিশ্রমী চা-জনগোষ্ঠীর ফাগুয়াকে আরও রঙিন করে তুলতে শ্রীমঙ্গলে ফাগুয়া উৎসবের আয়োজন করে ফাগুয়া উৎসব উদযাপন পরিষদ। চা-জনগোষ্ঠীর জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃত্বে উঠে আসা ব্যক্তিদের সম্মিলনে শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে ফুলছড়া চা-বাগানের মাঠে আয়োজন করা হয় এই ফাগুয়া উৎসব। এ তথ্য জানান আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব প্রাণেশ গোয়ালা।
উৎসবে কেবল রঙের হোলিই নয়, ছিল ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তত ৩০টি পরিবেশনা। পত্রসওরা, নৃত্যযোগি, চড়াইয়া নৃত্য, ঝুমুর নৃত্য, লাঠিনৃত্য, হাড়িনৃত্য, পালা নৃত্য, ডং ও নাগরে, ভজনা, মঙ্গলা নৃত্য, হোলিগীত, নিরহা ও করমগীত এক সাথে উপভোগ করতে পেরে যেমন আনন্দে ভেসেছেন চা শ্রমিকরা, তেমন অভিভূত হয়েছেন উৎসবে আসা নাগরিক সমাজও।
ফাগুয়া উৎসবটি ঘণ্টা বাজিয়ে উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। তিনি বলেন, ফাগুয়া উৎসবটি আসলে ব্যতিক্রম। এমন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ভালো লাগছে।
তিনি বলেন, এক সাথে নৃত্য-গীতের এত বৈচিত্রপূর্ণ আয়োজন দেখে অন্য সবার মতো আমিও অভিভূত। আমার বিশ্বাস চা-বাগানের সংস্কৃতি এই অঞ্চল তথা দেশের একটি সম্পদ। এটি চর্চা ও সুরক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এই উৎসব অব্যাহত রাখতে হবে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলার চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্ধেন্দু কুমার দেব।
সিলেট থেকে উৎসবে যোগ দিতে আসা উষা সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের প্রধান চা-জনগোষ্ঠীর তরুণী তমিশ্রা তিথি বলেন, চা-বাগানেই যে এত নৃত্য-গীতের সমাহার আছে এখানে না এলে আমার জানা হতো না। বীরহা আর করমগীত আমি প্রথমবার দেখলাম।
গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য দেন ভারতীয় সহকারী কমিশনার নীরাজ কুমার জায়সওয়াল। তিনি বলেন, চা-বাগানে পৌঁছাতেই কানে বাজলো পাহাড়িয়া মাদলের সুর। চা-বাগানের অন্য পাড়ায় গিয়েও চোখে পড়লো একই দৃশ্য। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী সবাই নাচছে- গাইছে-আনন্দ করছে। অনেক আয়োজন দেখেছি, তবে এমন আয়োজন প্রথম দেখলাম। চা-বাগানের মানুষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এত সুন্দর না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
দেউন্ডি চা-বাগান থেকে আসা প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস জানান, শত দুঃখ-কষ্ট, শত অভাব-অনটনের মধ্যেও উৎসবের কয়েকটি দিন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করেন। শ্রমিকেরা এই আনন্দ ভাগাভাগি করেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে। দূর-দূরান্তের চা-বাগান থেকে মেয়েরা নাইওর আসে জামাইসহ।
আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব কালিগাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা বলেন, এবার ৩য় বারের মতো এই আয়োজন। আয়োজনটি জাতির জনককে উৎসর্গ করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে চা শ্রমিকদের এটি একটি বিশেষ আয়োজন। আশা করি পরবর্তী বছর আরও বড় আয়োজনে ফাগুয়া উৎসব করা হবে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, চা-বাগানের কৃষ্টি, সংস্কৃতি যেন কোনোভাবে বিলুপ্ত না হয় সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ফাগুয়া উৎসব যেন বন্ধ না হয় সেজন্য আমরা কিছু সহযোগিতা করেছি। এই সুন্দর সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব সবার। এটি যেন প্রত্যেকবার করা যায় সেজন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা করছি।
পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করেন চা শ্রমিক সন্তান প্রকাশ ভর ও পিংকি বর্মা।