সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শাহাব উদ্দিনের নামে ধলাই নদীর বারকি শ্রমিক, নদীর তীরবর্তী ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর এলাকার ওয়াশিংপ্ল্যান ও ভাইব্রেটার থেকে ফাঁড়ি পুলিশের লাইনম্যানের চাঁদা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে এসআই শাহাব উদ্দিনের নামে ফাঁড়ি পুলিশের লাইনম্যান এরশাদ মিয়ার চাঁদা আদায়ের একটি অডিও ক্লিপ সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
জানা গেছে, সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় উপজেলার নিম্ন আয়ের বারকি শ্রমিকেরা বিভিন্নভাবে আয়-রোজগার করে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনরকম জীবন-যাপন করছেন। বারকি শ্রমিকেরা অর্থ সংকটে থাকায় কোন ব্যবসা বাণিজ্য করতে না পেরে ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের নিয়ে বালু চালনি করে চিপ পাথর (বালুর বড় দানা) আহরণের পর বিক্রয় করে। কেউ কেউ আবার সারাদিন ধলাই নদীতে কুড়িয়ে ছোট ছোট সাদা ও লাল পাথর একত্রিত করে বিক্রয় করেন।
অন্যদিকে ফাঁড়ি পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য ও বিজিবির অসাধু কতিপয় কর্মকর্তাকে টাকা দিয়ে কিছু বারকি শ্রমিক বাঙ্কার, কমলাছড়া ও সাদাপাথর থেকে সিঙ্গেল ও ‘ভুতু পাথর’ এনেও বিক্রয় করে। এসব বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শাহাব উদ্দিনের নির্দেশে ফাঁড়ি পুলিশের লাইনম্যান এরশাদ মিয়া দীর্ঘদিন ধরে নৌকা প্রতি একশত থেকে শুরু করে বারোশত টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলে আসছে বলে জানিয়েছেন বারকি শ্রমিকেরা।
সম্প্রতি এরশাদ মিয়া এসআই শাহাব উদ্দিনের নামে বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার সময় স্থানীয় কলাবাড়ি গ্রামের এক শ্রমিক পুলিশকে চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে শ্রমিক ও চাঁদা উত্তোলনকারী এরশাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এসময় ওই বারকি শ্রমিক স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাকে মোবাইল ফোনে এরশাদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। এসময় এরশাদ মিয়া নিজেই বলেন, ‘এসআই শাহাব উদ্দিন স্যার বলছে বলেই আমি তাদের কাছ থেকে টাকা তুলি। এই অল্প টাকার জন্য নেতাদের কোন দেওয়ার কি দরকার।’ ওই অডিও ক্লিপটি প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ধলাই নদীর ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর, গুচ্ছগ্রামে অবস্থিত ওয়াশিংপ্ল্যান ও ভাইব্রেটার ব্যবসায়ীদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক ফাঁড়ি পুলিশের নামে এক হাজার ও এরশাদের জন্য একশত টাকাসহ মোট এগারো শত টাকা প্রতিদিন চাঁদা উত্তোলন আসছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বারকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি উপজেলার ধলাই নদীর পশ্চিমপাড়ের ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর, গুচ্ছগ্রাম, বেড়াইয়ের ঘাট এবং নদীর পূর্বপাড়ের দয়ার বাজার, কালাইরাগ, লিলাইবাজার এলাকার বারকি শ্রমিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বারকি শ্রমিক, স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের টাকা আদান-প্রদানের কয়েকটি অডিও ক্লিপ প্রতিবেদকের সাথে সংরক্ষিত রয়েছে।
গত শনিবার ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি বারকি নৌকার সামনের গলুইয়ে বসেছেন ৩৮ বছর বয়সী এক যুবক। ওই নৌকার পেছনের গলুইয়ে তাঁর স্ত্রী ও মাঝে বসা ৮ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে নৌকা চালিয়ে বাঙ্কার এলাকা থেকে গুচ্ছগ্রামে আসছেন তাঁরা।
এ শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদিন কষ্ট করে বিভিন্নভাবে পাথর আহরণ করে যখন তারা ঘাটে এসে বিক্রয় করে টাকা পায় তখন সব কষ্ট ভুলে যায়। টাকাগুলো হাতে মহা খুশি হলেও একটু পরেই সারাদিনের কষ্ট বিনিময়ে উপার্জিত টাকা থেকে ভাগ দিতে হয় ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি লাইনম্যান এরশাদ মিয়াকে। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সারাদিনের কষ্টের উপার্জিত টাকা থেকে পুলিশের লাইনম্যানকে টাকা দিতে মনে না চাইলেও বাধ্য হয়েই দিতে হয়। টাকা না দিলে পুলিশ এসে নৌকা আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে যাবে তখন টাকা আরও বেশি লাগবে আবার নৌকা আটক করে রেখেও দিতে পারে।
কত টাকা দিতে হয়; এমন প্রশ্নে তাঁরা বলেন, এটার কোন ঠিক নাই, চিপ পাথর আনলে নৌকা প্রতি একশো থেকে শুরু করে যত নিতে পারে। আর সিঙ্গেলসহ অন্য পাথর আনলে হাজার টাকা দিতে হয়।
ওয়াশিংপ্ল্যানের কয়েক ব্যবসায়ী জানান, আমাদের মেশিন চললেই প্রতিদিন পুলিশের জন্য এরশাদ মিয়াক এগারো শত টাকা দিতে হয়। পুলিশ কে টাকা না দিয়ে এখানে ব্যবসা করা যায় না। এরশাদ মিয়া সারাদিন এখানেই থাকে। ভোর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বারকি শ্রমিকদের নৌকা থেকে ও আমাদের টাকা তুলেন। বারকি শ্রমিকেরা চিপ পাথর, সিঙ্গেল ও ভুতু পাথরের জন্য আলাদা আলাদা টাকা দেয়। শ্রমিকদের নৌকা থেকে একশো থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।
স্থানীয় প্রভাবশালী একটি ওয়াশিংপ্ল্যানের মালিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, ‘আমাদের ওয়াশিংপ্ল্যান চললেই প্রতিদিন এগারো শত টাকা দেয় ঠিক আছে কিন্তু এর বাইরে ফাঁড়ি পুলিশের এসআই শাহাব উদ্দিন এরশাদের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়। রাতের আঁধারে যাতে সাদা পাথর চুরি না হয় সেই জন্য ফাঁড়ি পুলিশের একটি টীম ধলাই নদীতে ডিউটিতে থাকে কিন্তু তাঁরা নৌকা প্রতি কয়েক হাজার টাকা নিয়ে সাদা পাথরের নৌকা ছেড়ে দেয়। এতে আমাদের কিছু লাভ হলেও ব্যবসায়ীদের থেকে শাহাব উদ্দিন স্যারের লাভ হয় বেশি। নৌকা দিয়ে আসা এসব পাথর যখন আমরা গাড়ী দিয়ে বিক্রয় করি তখন গাড়ী প্রতি ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। আমরা যদি প্রতি গাড়ীতে টাকা না দেই তাহলে রাস্তায় গাড়ী আটক করে ১০ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতে হয়।’
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে এরশাদ মিয়া বলেন, এখন তো সব ওয়াশিংপ্ল্যান চলে না, টাকাও তেমন উঠে না। টাকা তুলে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই শাহাব উদ্দিনকে দেন নাকি থানায় দেন এমন প্রশ্নে এরশাদ মিয়া সরাসরি কথা বলবে বলে ফোন কেটে দেন।
অকপটে এরশাদ মিয়া জানান, প্রতিবেদক যা বলেছে তা পুরোপুরি সত্য না, তবে অনেকাংশই সত্য।
অভিযুক্ত ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই শাহাব উদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘এরশাদ নামের কাউকে আমি চিনি না।’
এরশাদের সাথে মাঝে মধ্যে ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ও বিভিন্ন স্থানে আড্ডা ছবি ভিডিও আছে বলে জানালে মুহূর্তেই তিনি এরশাদকে চিনেন জানিয়ে বলেন, ‘এরশাদ মাঝেমধ্যে আমার সাথে দেখা করে বিভিন্ন মামলার বিষয়ে কথা বলার জন্য, আর কিছু না।’ এরশাদকে দিয়ে আপনি চাঁদা উত্তলন করেন কি না; এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা আমি জানি না, এখন জানতে পেরেছি। আমি এসব কথা ওসি স্যারকে জানাচ্ছি বলে ফোন কেটে দেন।’
এ ব্যাপারে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) শেখ সেলিম বলেন, ‘এ ধরণের কোন অভিযোগ কেউ করেনি এবং আমিও শুনি নাই। তবে কেউ যদি পুলিশের নামে টাকা তুলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সে কি পুলিশের নাম বিক্রয় করে টাকা তুলে নাকি পুলিশের কোন কর্মকর্তা তাকে বলেছে। এ বিষয়ে আপনার কাছে কোন তথ্য থাকলে আমাকে দিয়ে সহযোগিতা করবেন, আমি তদন্ত করবো।’