বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া সংকট দূর করতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে যে ঋণ চেয়েছে, সে ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে আইএমএফ। গত দু’সপ্তাহ ধরে ঢাকায় আলোচনা শেষ করেছে সংস্থাটির সফররত মিশনটি। বুধবার (৯ নভেম্বর) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে শেষে হচ্ছে তাদের এই সফর।
ঋণের শর্ত নিয়ে টানা ১৫ দিন সরকারি বিভিন্ন দফতর ও সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষির পর বুধবার একটি বিবৃতি দেওয়ার কথা সফররত আইএমএফ মিশনের। সফরের আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
সরকারের সঙ্গে আলোচনাকে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকে। আজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা শেষ করে বিবৃতি দেবে আইএমএফ মিশন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আলোচনার অগ্রগতি বিবেচনায় তারা মনে করছেন, আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। অর্থাৎ আইএমএফ মিশনের অবস্থান ইতিবাচক। তবে চূড়ান্ত ফয়সালা হবে সংস্থাটির বিভিন্ন শর্তের বিষয়ে সরকারের সম্মতির ওপর।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেয় সরকার। এরপর নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন তথ্য যাচাইয়ের জন্য দুই সপ্তাহের সফরে ঢাকায় আসে আইএমএফ মিশন। গত ২৬ অক্টোবর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। মিশনকে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের প্রধানদের। ধারণা করা হচ্ছে, ঋণ পেতে সেসব পরামর্শ মানতে হবে বাংলাদেশকে।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে ঋণ পেতে আইএমএফের কিছু শর্তে নমনীয় হয়েছে সরকার। যদিও শর্তগুলো অর্থনীতির জন্য ভালো হলেও তা সরকারের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। বিশেষ করে জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ যেখানে বিপাকে পড়েছেন, এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী বছরের মধ্যে ভর্তুকি খাতে সংস্কার আনতে হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের এই সিদ্ধান্ত মানতে গেলে জিনিস পত্রের দাম আরও বেড়ে যাবে।
অবশ্য রাজধানীর পল্টনে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সংলাপ অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সভাপতি জসিম উদ্দিন দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আইএমএফের ঋণ না নেওয়ার কথাও বলেছেন।
যদিও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সংকটের সময়ে ঋণ পেলে সরকারের আর্থিক চাপ কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিশ্চিত থাকতে পারেন, আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে। তারা এ ব্যাপারে আমাদেরকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন, ঋণের টাকা পেলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বাজেট সহায়তা ও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করা হবে। মোট ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে তিন কিস্তিতে। প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।
রিজার্ভ নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়ন
বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে না আইএমএফ। তবে যেভাবে কমছে তা অব্যাহত থাকলে উদ্বেগজনক পর্যায়ে যেতে পারে। এ বাস্তবতায় রিজার্ভ সুরক্ষায় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর শেষে প্রধান কার্যালয়ে একটি রিপোর্ট দেবে। এর পরই মূলত কী কী শর্ত থাকবে চূড়ান্তভাবে তা জানা যাবে। দু’পক্ষের সম্মতির পর ঋণ প্রস্তাব উঠবে আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে অংশ নেন। গত দু’সপ্তাহে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে মিশন। এসব বৈঠকে ডলারের দর নির্ধারণ, সুদহারের বিদ্যমান সীমা এবং আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবায়ন পদ্ধতি, রাজস্ব, মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
যে সব প্রতিশ্রুতি দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক
সফররত মিশনকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডলারের দর বৃদ্ধির এ সময়ে অসম প্রতিযোগিতা চলছিল। যে কারণে ব্যাংকগুলো নিজেরাই বাজারভিত্তিক একটি দর ঠিক করেছে। চলতি বছরের শুরুতেও আমদানিতে ৮৬ টাকার নিচে থাকা ডলার এখন ১০৬ টাকা। রেমিট্যান্সে ৮৫ টাকার নিচে থাকা ডলারের দর পাচ্ছে ১০৭ টাকা। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের এ অবস্থানকে আইএমএফ মিশন যৌক্তিক মনে করে। সুদহারের সীমার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ে এমনিতেই চাপে বাংলাদেশ। একবারে সীমা তুলে দিলে সুদহার অনেক বাড়বে। তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে দরিদ্র শ্রেণি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যমান সীমা তুলে দিলে ব্যাংকের আয় বাড়বে। যার বড় সুবিধাভোগী হবে ব্যাংকের মালিকপক্ষ।
যে কারণে এখনই সীমা পুরোপুরি তুলতে চায় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সীমা বাড়ানো বা আংশিক প্রত্যাহারের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
আর্থিক খাতের সংস্কার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দেশের মন্দ ঋণের বড় অংশই যে ১০টি ব্যাংকে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আলাদাভাবে তদারকির উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কম দেখানোর ক্ষেত্রে যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা ছিল করোনার কারণে সাময়িক ব্যবস্থা। ঋণখেলাপিদের বিষয়ে কঠোর নীতি নেওয়াসহ ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজস্ব আইন সংশোধনেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া চলমান আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে কর ছাড় আছে, ধীরে ধীরে তা কমানো হবে।
আমদানিতে খরচ অনেক বাড়লেও রফতানি এবং রেমিট্যান্স সে হারে বাড়ছে না। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রফতানি ও রেমিট্যান্স কমেছে।
এর মধ্যে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রফতানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপক চাপে পড়েছে। গত আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর পেরোনো রিজার্ভ কমে মঙ্গলবার(৮ নভেম্বর) ৩৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আইএমএফের মানদণ্ডের আলোকে হিসাব করলে নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ শিগগিরই গ্রস রিজার্ভের পাশাপাশি নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করবে।