বাক্সভর্তি ডলারের লোভে পড়ছেন না তো!

দীন ইসলাম বেশ গুরুতর অভিযোগ নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। বিদেশ থেকে তার একটি পার্সেল এসেছে। সেই পার্সেলের শুল্ক, স্ক্যানিং চার্জ, বিশ্ব ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলাসহ সব ধরনের চার্জ বাবদ আড়াই লাখ টাকা তিনি দিয়েছেন। তবুও বিমানবন্দরের কর্মীরা পার্সেলটি তাকে দিচ্ছে না। বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশের কাছে সব তথ্য দিয়ে সহায়তা চাইলেন তিনি। পার্সেলে কে পাঠিয়েছে, কী এসেছে সেটি জানতে চাইলে আর মুখ ‍খুলছেন না দীন ইসলাম। অনেক পীড়াপীড়ির পর দীন ইসলাম জানালেন, তার বিদেশি বন্ধু বাক্সভর্তি ডলার পাঠিয়েছে। এ তথ্য শুনে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের বুঝতে বাকি রইলো না, প্রতারকদের বাক্সভর্তি ডলারে লোভের ফাঁদে পড়ে আড়াই লাখ টাকা খুইয়েছেন দীন ইসলাম!

মানুষকে লোভে ফেলে নানা রকম প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। বিদেশি বন্ধুর বাক্সভর্তি ডলার কিংবা দামি উপহারের ফাঁদটি বেশ পুরাতন হলেও লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ফাঁদে পড়ার গল্প

শুরুতে পার্সেল সম্পর্কে বলতে না চাইলেও পরবর্তীতে অনার্স পড়ুয়া দীন ইসলাম কথায় কথায় জানালেন বিস্তারিত। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পরিচয়ে ফেসবুকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এক নারীর। দেড়-দুই মাস আলাপ চলতে থাকে তাদের মধ্যে। এই সময়ে প্রতারক চক্র দীন ইসলামের আস্থা অর্জনে নানান রকম কথা বলে। যদিও দীন ইসলাম বুঝতে পারেননি কিছুই। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান শুনে দীন ইসলামকে সহায়তা করার আশ্বাসও দেওয়া হয়, যদিও শুরুতে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।

পরবর্তী তাকে জানানো হয়, তার জন্য উপহার পাঠানো হয়েছে, সেটি যেন শুল্ক পরিশোধ করে গ্রহণ করে নেয়। কিছুদিন পরেই বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তকর্তা পরিচয়ে ফোন আসে দীন ইসলামের কাছে। বলা হয় পার্সেলটির শুল্ক বাবদ দিতে হবে ৩৩ হাজার টাকা। এতো টাকা কোথা থেকে দেবেন তিনি? যদিও বিদেশি বন্ধু তাকে বারবার বলছে তোমার জন্য মোবাইল, ঘড়িসহ সারপ্রাইজ গিফট আছে, দ্রুত সংগ্রহ করে নাও।

লোভের ফাঁদে পড়ে দীন ইসলাম ধার করে প্রথমে ৩৩ হাজার টাকা প্রতারক চক্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠায়। পরেরবার তাকে আবারও কাস্টম পরিচয়ে ফোন করা হয়, বলা হয় পার্সেলের বক্সে মোবাইল, ঘড়ি ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে। সেটি স্ক্যানিং করতে দিতে হবে আরও ৫৫ হাজার টাকা। তখনও কোনও ধরনের সন্দেহ ছাড়াই আবারও প্রতারক চক্রের ব্যাংকে টাকা পাঠান তিনি।

আবারও কাস্টমস পরিচয়ে ফোন! এবার বেশ রাগী কণ্ঠ! দীন ইসলামকে দেখানো হয় ভয়। বলা হয়, আপনার কার্টন ভর্তি ডলার। এটি আপনি আগে জানাননি। আপনার নামে মানি লন্ডারিং মামলা হবে। যদি ডলার নিতে চান তাহলে ‘বিশ্ব ব্যাংকের’ অ্যাকাউন্ট খুলে তারপর নিতে হবে। এজন্য দাবি করা হয় আরও এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এভাবে সব মিলিয়ে আড়াই লাখ খুইয়েও হুঁশ ফেরেনি দীন ইসলামের। টের পাননি প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে গেছেন তিনি।

সাবধানতা

দীন ইসলাম বিমানবন্দরে এসেছিলেন তার বাক্সভর্তি ডলারের খোঁজে। কোথায় পার্সেল রাখা সেখানে তাকে নিয়ে গেলে তিনি তার বাক্সটি খুঁজে নিয়ে যাবেন। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ তাকে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা বললেও বিশ্বাস করতে চাননি। বরং উল্টো সন্দেহ করেন পুলিশ তার ডলার ভর্তি বাক্স নিয়ে নিতে চায়।

পরবর্তী আমর্ড পুলিশ তার দেওয়া টাকার ব্যাংক স্লিপ বিশ্লেষণ করে জানায়, কাস্টমস কোনও পণ্যের শুল্ক আদায় করলে সেটি সরকারি ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে দিতে হয়। কোনও বেসরকারি ব্যাংকে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নয়। কাস্টমস কোনও পার্সেলের জন্য গ্রহীতাকে কখনও ফোন করে না। বিমানবন্দরে স্ক্যানিং চার্জ বলে কোনও চার্জ নেই। বিশ্ব ব্যাংকে কোনও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ নেই।

আড়াই লাখ টাকা খুইয়ে হতাশায় পড়েন দীন ইসলাম। তিনি বলেন, আমার নিজের কোনও টাকা নেই, বিদেশে আমার এক বন্ধু থাকে, তার কাছ থেকে ধার করে টাকা নিয়েছি। এতো টাকা আমি শোধ করবো কীভাবে। আবার পরিবারের কোনও সম্পদও নেই যে বিক্রি করে শোধ করবো।

আছে আরও ঘটনা

দীন ইসলামের মতো অনেকেই প্রতারক চক্রের লোভের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ঢাকার বাসিন্দা ইয়াসিন আরাফাত খানের কাছেও এ রকম একটি চক্র যোগাযোগ করেছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের ব্যবসা করার সহায়তার কথা বলে টাকা পাঠানোর লোভ দেখানো হয় তাকে। তার কাছেও কাস্টমস পরিচয়ে ফোন আসে, আর শুল্ক বাবদ ৫৫ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তবে সন্দেহ হওয়ায় কাস্টমসে যোগাযোগ করে ইয়াসিন আরাফাত।

অন্যদিকে সালমান আহমেদের কাছে যুক্তরাজ্যের এক নারী পরিচয়ে যোগাযোগ করে। আলাপে এক পর্যায়ে তাকে জানানো হয়, ক্যান্সারে আক্তান্ত এই নারীর অঢেল সম্পত্তি, মৃত্যুর আগে সালমানের মতো বিশ্বস্ত কারও সহায়তায় বাংলাদেশে দান করতে চান। সব মিলিয়ে ৫ মিলিয়ন ডলার দান করবেন। আর যেহেতু সালামান পরিশ্রম করবেন তাই তাকে দেওয়া হবে ২৫ শতাংশ। তার কাছেও এবার ফোন আসে বিমানবন্দরের কাস্টমস পরিচয়ে, চার্জ হিসেবে দিতে হবে ৪৫ হাজার টাকা। সালমান সেই টাকা পরিশোধের জন্য প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করেন। আর পরিবারের পরামর্শে যাচাই করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো।

পুলিশ কী বলছে

এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক বলেন, এ ধরনের ফাঁদে পড়ে কেউ কেউ খোঁজ নিতে বিমানবন্দরে আসেন। কিন্তু প্রতারণার পুরো প্রক্রিয়া হচ্ছে অনলাইন আর ফোনে। অনেকেই প্রতারক চক্রের কথায় এতো বেশি প্রভাবিত হন যে, বিশ্বাসও করতে চান না তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তারা পরিবার বা বন্ধু কারও কাছে শেয়ারও করেন না। অথচ খুব সহজে বিবেচনা করলেই বিষয়টি ধরা সম্ভব। কেন একজন অপরিচত মানুষ টাকা দেবে। যদি দেয়ও সে কোনও ব্যাংকের মাধ্যমে না দিয়ে বাক্সের মাধ্যমে পার্সেলের কথা কেন বলছে। সরকারি ফি/ চার্জ কখনও কোনও ব্যাক্তিগত বা কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়া হয় না।

জিয়াউল হক বলেন, মানুষ যদি তার নিজের লোভকে সামলাতে পারে তাহলে কখনই এ ধরনের প্রতারণার শিকার হবেন না।