বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস

‘বিপদ’ না এলে হাত ধোয় না কেউ

দেশে যখন করোনার প্রথম থাবা এসেছিল, তখন জীবন বাঁচাতে হলেও মানুষ হাত ধোয়ার বিষয়ে মনোযোগী ছিল। সাবান কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার কাজ ছিল প্রতিদিনের রুটিনের অংশ। করোনা যতটা দুর্বল হতে শুরু করেছে, কিংবা তার বিরুদ্ধে লড়াইটা জোরদার হয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে হাত ধোয়ার বিষয়টা। এখন কেউ হাত ধোয় না বললেই চলে। চার বছর আগে ওয়াটারএইড ও ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত দেশব্যাপী জাতীয় সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার জ্ঞান থাকলেও তা প্রতিপালনে সবার মাঝে অনীহা রয়েছে।

ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ সালের তথ্য বলছে, ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছে, টয়লেটের পর সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়, ৪০ শতাংশ বলেছেন খাওয়ার আগে, ৩৬ শতাংশ বলেছেন খাবার তৈরির আগে, ১৫ শতাংশ বলেছেন শিশুদের খাওয়ানোর আগে এবং ৯ শতাংশ বলেছেন শিশুকে শৌচ করানোর আগে হাত ধোয়ার কথা। অর্থাৎ হাত ধোয়ার সাধারণ জ্ঞান তাদের আছে।

হাতের স্বাস্থ্যবিধি বৈশ্বিকভাবে পালনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানের মধ্যে দিয়ে আজ শনিবার (১৫ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বৈশ্বিক এবং স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করার জন্য বিশ্ব হাতধোয়া অংশীদার (জিএইচপি)-এর উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে ১৫ অক্টোবর দিনটি ‘বিশ্ব হাতধোয়া দিবস’ বা ‘গ্লোবাল হ্যান্ডওয়াশিং ডে’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের ৭০টি দেশের প্রায় ১২ কোটিরও বেশি শিশু সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা শুরু করেছিল। তবে হাতধোয়ার এই যুগান্তকারী ধারণাটি সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন ভিয়েনার বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. ইগনাল সেমেলউইজ।

ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮-এর প্রতিবেদনে পাঁচটি পৃথক ক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে প্রাপ্ত ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এই ক্ষেত্রগুলো হলো—গৃহস্থালি, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও ফুটপাতের খাদ্য বিক্রেতা। এসব ক্ষেত্রে এসডিজির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সূচক, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ভিশন ২০২১ এবং ভিশন ২০৪১ ইত্যাদির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা হয়।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাত ধোয়ার জ্ঞান খাবারের আগে ও টয়লেট করার পর সবচেয়ে বেশি। তবে কম জ্ঞান খাবার তৈরির আগে ও শিশুকে খাওয়ানোর আগে। সমীক্ষার তথ্য আরও বলছে, খাবার তৈরির আগে হাত ধুয়েছে এমন রেস্তোরাঁ কর্মচারীর সংখ্যা খুব কম। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ খাবারের আগে হাত ধোয় না।

গবেষকদের মতে, স্বাস্থ্যবিধির নানা রকম প্রাথমিক জ্ঞানের মধ্যে সঠিকভাবে হাত ধোয়া অন্যতম। হাত ধোয়া দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস্থতার জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়া খুবই জরুরি। নানা কারণে হাত নোংরা হয়ে প্রতিদিন হাজারো জীবাণু মানবদেহে সংক্রমিত হয়। অবচেতনভাবে প্রতিনিয়ত আমরা হাত দিয়ে ক্রমাগত চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করে থাকি। হাত অপরিষ্কার থাকলে এমন স্পর্শের মাধ্যমে দেহের ভেতরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে খাবার গ্রহণের আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলেই যে জীবাণুমুক্ত হয়, তা নয়। সঠিক নিয়মে সাবান দিয়ে হাত না ধুলে নানারকম ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণু হাতের মাধ্যমে খাদ্যের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। যার ফলস্বরূপ ডায়রিয়া, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা এমনকি কোভিড-১৯ রোগের মতো নানাবিধ সংক্রামক রোগ হতে পারে। আর এসব রোগ থেকে বাঁচতে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার সু-অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।

ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন শিশু বা প্রতি চার জনে একজন শিশু ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস বছরে প্রায় ১০ লাখ ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু এবং প্রায় ১৬ শতাংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণজনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। তবে শুধু পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে তাতে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে ক্ষারযুক্ত সাবান, তরল সাবান বা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার এসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু ধ্বংসের জন্য অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বস্তুত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার অভ্যাস যেকোনও মহামারি বা রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ, কিংবা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

ওয়াটারএইড বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. নুরুল্লাহ আওয়াল বলেন, ‘হাইজিন সার্ভের পর করোনার কারণে প্রাসঙ্গিক অনেক কারণ পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য চর্চা বা সুস্থতার থাকার প্রবণতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সার্ভের ফলাফল বলছে, তখন হাত ধোয়ার চর্চা ও জ্ঞান কমই ছিল। সেটি আমাদের করোনাকালীন সময়ে যথেষ্ট বেড়েছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অংশগ্রহণে এ কাজটি সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে অংশীজন বা উন্নয়ন সহযোগীরা একটা লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছে। তার ফলে তখন হাত ধোয়ার চর্চা অনেক বেড়েছিল। বিভিন্ন স্যাম্পল সার্ভে থেকে দেখা গেছে, ৬০-৭০ শতাংশ বেড়েছিল। যেটি আবার পরবর্তী চার মাসে ২০ শতাংশে চলে আসছে।’

তিনি বলেন, ‘‘যখন করোনার ঢেউ চলে গেলো, মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার পর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস কাজ করা শুরু করে। তাতে তারা মনে করে, ‘এখন হয়তো হাত ধোয়ার প্রয়োজন অতটা নেই’, অথবা ‘করোনা দুর্বল হয়ে গেছে’ অথবা ‘করোনার কারণে তেমন গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে না’—যেভাবেই হোক, একটি সচেতনতার ঘাটতি তৈরি হয়। যার কারণে দেখা যায়, হাত ধোয়ার চর্চা চরমভাবে কমে আসে। দ্বিতীয়ত, হাত ধোয়ার চর্চার জন্য যে অবকাঠামো প্রাপ্তি ও প্রস্তুতি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যায়। সাবান, প্রবহমান পানির ব্যবস্থা কিন্তু আমরা আর মাঠ পর্যায়ে দেখিনি। বিভিন্ন স্থাপনা কিংবা মার্কেটে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা কিংবা হাত ধোয়ার বিষয়ে যে মনিটরিং ছিল, সেটা আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর আমরা দেখিনি। আমাদের সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনায় এখন জোর দিতে হবে।’’

পরামর্শ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, করোনার সংক্রমণ হয়তো কমে গেছে, কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার যে একটা নিয়ামক হাত ধোয়া—সেটি তো আর যায়নি। আমাদের এই হাত ধোয়ার জায়গা ফোকাস করে তার চর্চা আবারও বাড়াতে হবে। এই বিষয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের সাপোর্ট ও তদারকি জরুরি। কারণ, রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের সবচেয়ে সহজ, সস্তা ও সুলভ পদ্ধতি হচ্ছে হাত ধোয়া।

কখন হাত ধোয়া জরুরি

যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি’র তথ্য অনুযায়ী, খাবার তৈরির আগে, সময়ে, এবং পরে, খাবার খাওয়ার আগে এবং পরে, বমি বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এমন কাউকে বাড়িতে সেবা করার আগে ও পরে, একটি কাটা বা ক্ষত চিকিৎসার আগে ও পরে, টয়লেট ব্যবহারের পরে, টয়লেট ব্যবহারকারী শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন বা পরিষ্কার করে দেওয়ার পরে, নাক ঝাড়া, কাশি বা হাঁচির পরে, একটি প্রাণী, প্রাণীর খাবার, বা প্রাণিজ বর্জ্য স্পর্শ করার পরে, পোষা প্রাণীর খাবার বা পেট ট্রিটস নাড়াচাড়ার পরে, আবর্জনা স্পর্শ করার পরে হাত ধোয়া জরুরি।

সঠিক উপায়ে হাত ধোয়ার পাঁচটি ধাপ

পরিষ্কার, প্রবহমান জল (গরম বা ঠান্ডা) দিয়ে আপনার হাত ভেজান, কল বন্ধ করুন এবং সাবান ব্যবহার করুন। সাবান দিয়ে ঘষে আপনার হাতে সাবানের ফেনা তৈরি করুন। আপনার হাতের পৃষ্ঠদেশ, আঙুলের মাঝে এবং নখের নিচে ফেনা সৃষ্টি করুন। অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য আপনার হাত ঘষুন। ২০ সেকেন্ড সময় বুঝতে হাত ধোয়ার সময় ‘হ্যাপি বার্থডে’ গানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুইবার গুন গুন করুন। পরিষ্কার, প্রবহমান জল দিয়ে আপনার হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং একটি পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে বা বাতাসে আপনার হাত শুকিয়ে নিন।

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘হাত দিয়ে আমরা খাবার খাই। সেখানে হাতে লেগে থাকা ময়লা আমাদের মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। হাতে লেগে থাকা ময়লা চোখ, ত্বক ও নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। এ কারণে হাত ধোয়া আমাদের জন্য জরুরি। বিশেষ করে যে দেশের মানুষ মল ত্যাগের পরে শৌচ কাজে হাত ব্যবহার করে, সেখানে মলের সঙ্গে থাকা জীবাণু হাতে ও চোখে চলে আসতে পারে। যেসব দেশে ধুলাদূষণ অত্যন্ত বেশি, সেখানে যেকোনও জায়গা থেকেই হাতে ময়লা চলে আসতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার কারণে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা ৬০ ভাগ কমানো গিয়েছিল। তাই হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।’