বাজারমূল্যে ঊর্ধ্বগতি, পূজোর আয়োজনে বড় হতাশা

ঘনিয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা। দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা তৈরির কাজে নিয়োজিত কারিগররা। তবে বর্তমানে বাজারমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিমা তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে অনেক। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃৎশিল্পীদের মজুরি।

এমন বাস্তবতায় উৎসবের খরচাপাতি নিয়ে হতাশ আয়োজকরা। তেমনি কাজ করেও মজুরিতে পোষে না; অভিযোগ কারিগরদের।

প্রতিমাশিল্পীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিমা তৈরির জন্য আগে যে সুতলি ৮০ টাকা ছিল, এখন ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। যে খের ১ হাজার টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটা কিনতে লাগছে ৮ হাজার টাকা।

অন্যদিকে ৪০ টাকার পাট ১৫০ টাকা, ৬০ টাকার লোহা ১২০-১৩০ টাকা, ২০০-২৫০ টাকার বাঁশ ৫০০-৬০০ টাকা, ৪০০ টাকা ফুটের কাঠ এখন ৬০০ টাকা, ২৫০০ টাকার পিক-আপের ভাড়া ৪ হাজার, ৩ হাজারের গাড়িভাড়া ৫ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, গতবার একজন কারিগর যেখানে ১ লাখ টাকায় কাজ করেছে সেই কারিগর একই জায়গায় এবার ৭০ হাজার টাকায় কাজ করছেন। মন্দির কমিটির বাজেট কমলেও সহকারি কারিগর যে ৪/৫ জন থাকছে তাদেরকে কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি মাথায় রেখে আগের তুলনায় বাড়িয়েই মজুরি দিতে হচ্ছে।

নগরীর দাড়িয়াপাড়া এলাকার নিম্বার্ক আশ্রমের মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করছেন কারিগর সাগর পাল। প্রতিমা তৈরির কাজে তিনি বিক্রমপুর থেকে সিলেট এসেছেন। ২৫ বছর ধরে যিনি প্রতিমা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।

কারিগর সাগর পাল বলেন, ‘এ বছর ১০টি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজ নিয়েছি। বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছি। এ বছর প্রতিটি প্রতিমা তৈরির খরচ ৭০ হাজার টাকা নিলেও আমাদের পোষাবে না। কারণ প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে রঙ, কাপড়, পুঁথির মালা, পরচুলা, চুমকি, শোলা ও কারিগরের মজুরিসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। শুধু পেশাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ কাজ করতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে ঢিলাঢালাভাবে দায় সেরেছিল পূজা মণ্ডপ কমিটি। এ বছর আশায় বুক বেঁধেছিলাম, কিন্তু বৈশ্বিক যুদ্ধের কারণে সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবারও লোকসান গুনতে হবে। স্থানীয় পূজা কমিটিও এ বাজেট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।’

ওই পূজা মণ্ডপের সভাপতি প্রদীপ কর্মকার বলেন, ‘বর্তমানে বাজারমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে দুর্গা পূজা অর্চনা, প্রসাদ কেনার খরচ—সবমিলিয়ে কমিটির সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে কারিগরের মজুরিসহ অন্যান্য উপকরণ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

মন্দিরের পুরোহিত বনমালী ভট্টাচার্য্য জানান, ‘আগামী ১ অক্টোবর ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এ বছর মা দুর্গা গজে (হাতি) আগমন করবেন। এর অর্থ শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। আর বিজয়া দশমীতে গমন করবেন নৌকায়। এর অর্থ শস্যবৃদ্ধি আশানুরূপ হলেও বন্যা ও জলোচ্ছাসে কিছু শস্য নষ্ট হবে।’

কারিগর দুলাল পাল জানান, ‘সিলেট সদরের বিভিন্ন বাড়ির পুজোর জন্য সব মিলিয়ে ৭৫ টি প্রতিমা তৈরির কাজ নিয়েছি। একটি চালা ঘরের মধ্যে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। দেবী দুর্গার সঙ্গে রয়েছেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও স্বরসতী। এছাড়া এখন পর্যন্ত বাঘ ও অশুরের মুখম-লসহ দেহের কাঠামো গঠন করা হয়েছে। প্রতিমাগুলো রোদে শুকানোর কাজ চলছে। আর কিছুদিন পরেই রঙ-তুলির আঁচড়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে প্রতিটি প্রতিমা।’

তিনি বলেন, ‘মৃৎশিল্পীদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এই কাজ করে আর পোষায় না।’

এদিকে সিলেট জেলায় এবার মোট ৪৫৬টি মণ্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হবে। যার মধ্যে সার্বজনীন ৪২৫টি আর পারিবারিক ৩১টি। আর সিলেট মহানগরে এবার মোট ১৫০টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গোৎসব। যার মধ্যে সার্বজনীন ১৩২টি এবং পারিবারিক ১৮টি।

জেলার ৪৫৬ টি এবং মহানগরের ১৫০টি মণ্ডপ মিলিয়ে সিলেটে মোট ৬০৬ টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

মহানগরের সার্বজনীন ও পারিবারিক মণ্ডপের সংখ্যা :

মহানগরের কোতোয়ালী থানায় মোট ৪০টি মণ্ডপের মধ্যে সার্বজনীন ২৯টি ও পারিবারিক ১১টি। জালালাবাদ থানায় সার্বজনীন ১৬ টি, পারিবারিক ০৪ টি। এয়ারপোর্ট থানায় সার্বজনীন ৩৮টি, পারিবারিক ০১টি। শাহপরান থানায় সার্বজনীন ২১ টি, পারিবারিক ০১টি। দক্ষিণ সুরমা থানায় সার্বজনীন ১৩টি। মোগলাবাজার থানায় সার্বজনীন ১৫টি, পারিবারিক ০১টি। মহানগরে সার্বজনীন ১৩২টি, পারিবারিক ১৮টি।

জেলার সার্বজনীন ও পারিবারিক মণ্ডপের সংখ্যা :

জেলার ৪৫৬ টি মণ্ডপের মধ্যে গোলাপগঞ্জে সার্বজনীন ৫৬টি, পারিবারিক ০৩টি। বালাগঞ্জে সার্বজনীন ২৮টি, পারিবারিক ০২ টি। কানাইঘাটে সার্বজনীন ৩৫টি। জৈন্তাপুরে সার্বজনীন ২০টি, পারিবারিক ০২টি। বিশ্বনাথে সার্বজনীন ২৪টি, পারিবারিক ০২টি। গোয়াইনঘাটে সার্বজনীন ৩৬টি। জকিগঞ্জে সার্বজনীন ৯৯টি। বিয়ানীবাজারে সার্বজনীন ৩৯টি ও পারিবারিক ১৩টি। কোম্পানীগঞ্জে সার্বজনীন ২৫টি, পারিবারিক ০১টি। ফেঞ্চুগঞ্জে সার্বজনীন ৩৭টি। ওসমানীনগর থানায় সার্বজনীন ২৬টি, পারিবারিক ০৮টি। জেলায় সর্বমোট সার্বজনীন ৪২৫টি, পারিবারিক ৩১টি।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এড. রঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘জেলায় ৪৫৬ টি পূজা মণ্ডপে এবার পূজো অনুষ্ঠিত হবে। উপজেলা ভিত্তিক প্রতিটি কমিটিকে ডিজে পার্টির নামে অশ্লীলতা বন্ধের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মণ্ডপগুলোতে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা ঘটাতে না পারে সে জন্য পুলিশ প্রশাসন সর্বদা দায়িত্ব পালন করবে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।’

সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের জানান, ‘আমরা পূজা মণ্ডপের লিস্ট করছি। যেখানে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে সেখানে পুলিশের টহল টিম যাতে টহল দেয় আমাদের পক্ষ থেকে সেরকম নির্দেশনা দেওয়া আছে।’

তিনি জানান, পূজোর সময় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে থানা পুলিশের পাশাপাশি পূজা মণ্ডপে আনসার, গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সদস্য থাকবে।