অক্টোবর থেকেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন

আগামী অক্টোবরে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে প্রস্তুত বাগেরহাটে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র (মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট)। এরই মধ্যে চলতি মাসের ১৫ আগস্ট থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। সে দিন মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্পের ইউনিট-১ এ ৯১ দশমিক ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর দুই মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা সম্ভব। মোট ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিটে ৬৬০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পান্ডে জানিয়েছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাপোর্টিং যত ধরনের ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সবই প্রস্তুত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের আগেই পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ এর নির্মাণ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে এই সফরকে কেন্দ্র করে কাজও এগিয়ে চলছে পুরোদমে। এই সফরে অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে এই প্রকল্পটিও উদ্বোধন করা হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন দুই দেশেরই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিচালনায় কয়লা আমদানি এবং তা সংগ্রহ, মজুত প্রক্রিয়া সহজতর করতে বিভিন্ন ধাপের কাজ এগিয়ে চলছে। পশুর নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই প্রকল্পের কয়লা আনতে যেন কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নদীর ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি স্থাপনা নির্মাণেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে— চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ার ব্যবস্থাপনায়। এই ধোঁয়া যেন পরিবেশ দূষণ করতে না পারে, সেজন্য আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকা থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। স্থানীয় জনসাধারণের ওপর ধোঁয়ার প্রভাব, পরিবেশের বিপর্যয়সহ সুন্দরবনের ওপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেই জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

সোমবার (২৯ আগস্ট) প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ও সর্বশেষ পরিস্থিতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলছে। কয়লা মজুতের জন্য চারটি শেড বানানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি শেডে কয়লা মজুত রাখা হয়েছে। আরেকটি শেডের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্যগুলোর কাজও এগিয়ে চলছে। এছাড়া উৎপাদন থেকে শুরু করে বিতরণ লাইনের কাজের বিষয়গুলো তদারকিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন দায়িত্বরতরা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কয়লা আমদানি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আমদানির আওতায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা এরই মধ্যে চলে এসেছে। আরও দুটি জাহাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। কয়লা আমদানি এবং চুক্তির বিভিন্ন বিষয় কিছুটা সময় সাপেক্ষ হবে। আমাদের মূল কনসার্ন হচ্ছে কয়লা হ্যান্ডেলিং করার বিষয়টি।

পরিবেশের বিষয় তুলে ধরে কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করা হয়েছে। এই মুহূর্তে ৬৯ গিগাওয়াট বা ৬৯ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একক কোম্পানি কাজ করছে। প্রতিটি স্টেশন থেকে সম্পূর্ণ পরিবেশগত ডাটা প্রদর্শিত হয়। কেন্দ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটে সব তথ্য রয়েছে। সব পরিবেশগত পরিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশগত প্রভাব রোধে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির সঙ্গে পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। বায়ু এবং পানি দূষণ কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। পরিবেশের জন্য কোনও ক্ষতি না হয়— সে বিষয়টি লক্ষ্য রেখে শুরু থেকেই এই প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। বায়ু এবং পানি দূষণ কমানোর জন্য একটি ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন সিস্টেম— যার মধ্যে সালফার অক্সাইডের নির্গমন নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও বাইপাস নেই। দূষণ এড়ানোর জন্য থাকছে সমন্বিত বর্জ্য এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম। পশুর নদীর দূষণ, ফ্লু গ্যাস নির্গমনের বিস্তৃত বিচ্ছুরণের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু চিমনি নির্মাণ (২৭৫ মিটারে), কয়লার জন্য একটি অগ্রিম জাহাজ আনলোডার নির্মাণের পাশাপাশি একটি সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত কয়লা স্টক ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। উচ্চ গ্রেড আমদানি করা হয়েছে, যেখানে ছাই এবং সালফার সামগ্রীসহ কয়লার অন্যান্য ব্যবস্থাগুলো রয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পান্ডে বলেন, ‘প্রকল্পটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান সুন্দরবন থেকে ৬৫ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত। তারপরও পরিবেশের নেতিবাচক দিকগুলোর বিষয়ে তথ্য পর্যালোচনা করেই আমরা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। এতে করে সুন্দরবনের ওপর পরিবেশগত কোনও প্রভাব পড়বে না। করোনার কারণে কাজে স্থিতাবস্থা থাকলেও এখন কাজে গতি বেড়েছে।’

পার ইউনিটে উৎপাদন খরচ কত হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা কয়লা আমদানিতে খরচ ও ডলারের দামের ওপর নির্ভর করবে। এছাড়া বাইরে যেসব দেশ থেকে কয়লা সংগ্রহ করা হয়, তাদের সরবরাহের ওপরও নির্ভর করবে। অন্যান্য প্রজেক্ট থেকে এর যাতায়াত এবং খরচ কম পড়বে। ইন্দোনেশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মোজাম্বিক কয়লা রফতানি করে। সেসব দেশের কয়লা আনা- নেওয়ার খরচ বিবেচনা করে আমদানি ঠিক করা হবে, যাদের কাছ থেকে দাম কম পাই। এছাড়া, কয়লা আমদানি প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদি। মজুত রাখার সময়সীমাসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকে।’

বাগেরহাট জেলার রামপালে অবস্থিত প্রকল্পটি ভারত সরকারের কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে নির্মিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে একটি ৫০/৫০ জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল পাওয়ার প্ল্যান্টের ৪০০ কেভি জিআইএস সুইচইয়ার্ড এবং আন্তসংযোগকারী ট্রান্সফরমারকে শক্তিশালী করা হয়। সেই থেকে এটি পায়রা পাওয়ার প্রজেক্ট থেকে বাংলাদেশের ২৩০ কেভি গ্রিড সিস্টেমে ৪০০ কেভি বিদ্যুতের হুইলিং সুবিধা পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে খুলনা অঞ্চলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ পাঠাতে সক্ষম।