বাগানের সাবেক নেতাদের আচরণে ক্ষুব্ধ চা শ্রমিকরা

মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতিতে এখন অচল দেশের চা-বাগানগুলো। শ্রমিকরা জানিয়ে দিয়েছেন মজুরি না বাড়ালে তারা কাজে যোগ দেবেন না।

এদিকে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির মতো যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতাদের পাশে না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে চা শ্রমিকদের। আন্দোলনের টানা ৭ দিন পার হওয়ার পরেও এই আন্দোলনের সাথে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতাদের একাত্মতা প্রকাশ না করা, আন্দোলনে সশরীরে উপস্থিত না হওয়া এবং সক্রিয় কোনো ভূমিকা না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট থেকে মজুরি বৃদ্ধির জন্য চা শ্রমিকদের শুরু হওয়া কর্মবিরতিতে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক নেতাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন সারাদেশের চা শ্রমিকরা। অবশেষে সারাদেশের চা-বাগানে অচলাবস্থা দেখে গত ১৬ আগস্ট চা শ্রমিকদের সাথে বসে কথা বলার জন্য শ্রীমঙ্গলে আসতে বাধ্য হন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) খালেদ মামুন চৌধুরী এনডিসি। তবে সেই আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং কর্মবিরতি চলমান থাকে।

আন্দোলন পরিস্থিতির ১ সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরেও চা শ্রমিকদের আশপাশে ঘেঁষতে দেখা যায়নি রাজেন্দ্র প্রসাদ বোনার্জী, বিজয় বুনার্জীসহ সাবেক চা শ্রমিক নেতাদের। এর ফলে চা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের পাশাপাশি সাবেক কমিটির নেতাদের নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে থাকে আন্দোলনের মাঠসহ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) চা শ্রমিকদের আন্দোলনের শুরুর ৮ম দিন দুপুরে চা শ্রমিক ইউনিয়নের এডহক কমিটির ব্যানারে সেবাসহ ৫০০ টাকা মজুররির দাবিতে শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। পরে চা শ্রমিক নেতা বিজয় বুনার্জীর নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বরাবরে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

এ সময় শ্রমিকনেতা বিজয় বুনার্জী ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলরত শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কমিটিকে মেয়াদোত্তীর্ণ, অবৈধ ও ব্যর্থ দাবি করে বলেন, তারা মালিকপক্ষের সাথে আঁতাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই শ্রমিক নেতারা চা-বাগান মালিকদের সাথে আঁতাত করে ১২০ টাকা মজুরির কাজ করে বড় বড় অট্টালিকার মালিক হয়ে গেছেন। তারা রাজকীয় জীবনযাপন করছেন। অথচ শ্রমিকদের দিন কাটছে দুঃখ-দুর্দশায়।

অর্থাৎ আন্দোলনের ১ সপ্তাহ পর বিজয় বুনার্জীকে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির সুর তুলতে দেখা যায়। যে বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো নেট দুনিয়ায় সমালোচনায় ঝড় বইতে দেখা গেছে।

সমালোচনা করে ফেসবুকে রঞ্জন স্পিডো নামের একজন লিখেছেন, ঘুম ভেঙে গেল না কি ভাই ওদের? আমার মতে দাবি আদায়ের আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। নিজেদের মধ্য দ্বন্দ্ব রাখার প্রয়োজন নেই।

শান্তা তাতী লিখেছেন, এই নেতারা টাকার জন্য নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছে। এরা চা শ্রমিকের দুঃখ কী বুঝবে?

এস কে কল্পন তাতী লিখেছেন, নিজের চেয়ারের জন্য সবাই ব্যস্ত।

সমালোচনা করে লিটন গঞ্জু নামে একজন লিখেছেন, এসব দালালদের কারণে চা শ্রমিকদের মধ্যে ভাঙন হচ্ছে। ভালো কাজে বাম হাত ঢোকানোর কাজ রাজেন্দ্র প্রসাদ বোনার্জীর দল সবসময় করে। আজ চা শ্রমিক মা-বোনেরা রাস্তায় নেমেছেন। আর এদিকে রাজেন্দ্র প্রসাদ বোনার্জী দলের মানুষ আর তার বাপদের নিয়ে আন্দোলন করছে।

এস পঞ্চম দাস নামের একজন লিখেছেন, বিজয়ের আমলে এক টাকা দুই টাকা মজুরি বাড়তো। কোন শরমে সে আবার কথা বলে? এখন দল-মত নির্বিশেষে দাবি আদায় করো। রাজনীতির খেলা বন্ধ করো আপাতত।

ফেসবুকের এক পোস্টের কমেন্টে ডালিম বোনার্জী নামের একজন লিখেছেন, বাপ যদি চোর হয় ছেলেও চোর হবে। আমার ভাইদের জানা নেই যে বিজয় বাবু কোনো পদে কখনও ছিলেন না। কেবল সংগ্রাম কমিটির মেয়াদের পরে আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি ছিলেন।

স্নেহা গুপ্তা লিখেছেন, এতদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? যেখানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করে চা শ্রমিকরা রাজপথে নেমেছে, সেখানে আপনারা বলছেন ৫০০ টাকা মজুরি করতে। এখন আপনাদের হুঁশ ফিরেছে না কি ভাই? এই আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে কি ঘুমিয়ে ছিলেন ভাই? যারা ৫০০ টাকা মজুরি দাবি করছেন তারা সবাই মালিকপক্ষের দালাল।

সুমিত পাল লিখেছেন, দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে দুই গ্রুপের গড় হিসেবে আসে ৪০০ টাকা মজুরি। এটাই ফাইনাল করে সবাই একত্রে কাজ করুন, সফল হবেন।

চা শ্রমিকরা বলছেন, এতদিন পরে এসে ৫০০ টাকা মজুরির সুর তোলার কারণ জানি না। সকলের নজর কাড়ার জন্য এমনটি করছেন হয়তো।

তারা বলেন, আমরা আশা করেছিলেন আন্দোলনের শুরুর দিন থেকেই তাদেরকে আমরা পাশে পাবো। কিন্তু তাদেরকে এতদিন খুঁজেও পাইনি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। চা শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের উচিত ছিল আন্দোলনে পাশে এসে দাঁড়ানোর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল সিলেট ভয়েসকে বলেন, সাধারণ মানুষের মতো আমারও প্রশ্ন- এতদিন তারা কোথায় ছিলেন? চা শ্রমিকদের ডাকে তারা এতদিন সাড়া দিলেন না কেন?

এই চা শ্রমিক নেতা বলেন, মূলত চলমান আন্দোলনটা নষ্ট করতেই আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর শ্রমিক ইউনিয়নের এডহক কমিটির ব্যানারে সেবাসহ ৫০০ টাকা মজুরির দাবিতে লোক দেখানো এই আন্দোলন করা হয়েছে। সেখানে ৪০-৫০ জনের বেশি মানুষকে দেখা যায়নি। অথচ বর্তমান কমিটির ডাকে সাড়া দিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে সারাদেশের হাজার হাজার চা শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমি বলবো, শ্রমিক ইউনিয়নের এডহক কমিটির ব্যানারে ৫০০ টাকা মজুরির লোভ দেখিয়ে দল ভারি করার মতলব নিয়ে তারা হঠাৎ করে মাঠে নেমেছে। তাদের মূল লক্ষ্য চা শ্রমিকদের বিভক্ত করা। তারা মালিকপক্ষের হয়েই এরকম একটি কাজ করছে বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বোনার্জী সিলেট ভয়েসকে বলেন, এই ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশের প্রাচীনতম ট্রেড ইউনিয়ন এবং প্রথম থেকেই এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল। চা শ্রমিকদের এই আন্দোলনটি সময়ের প্রয়োজনে দাবিটি যৌক্তিক। শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধি হোক এটাই কাম্য।

এতদিনে পরে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করায় সমালোচনা প্রসঙ্গে রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিজয় বুনার্জী সিলেট ভয়েসকে বলেন, আমি ট্রেড ইউনিয়নের কোনো কর্মকর্তা নই। তবে আমি আন্দোলনটাকে সমর্থন করি। আন্দোলনে নগদ ৩০০ এবং হিডেন বেনিফিট ২০০ সর্বসাকুল্যে ৫০০ টাকা দাবি করি। মাননীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ সংসদে শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা করার কথা বলেছেন। সেদিন আমি শুধু তারই পুনরাবৃত্তি করেছি।

তিনি বলেন, এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সময়ে মজুরি অবশ্যই ৩০০ টাকা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ৩০০ টাকার নিচে যেন শ্রমিকরাও রাজি না হয়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ যেন এই দাবি থেকে সরে না আসেন, তাদের প্রতি এটাই আমার আহ্বান থাকবে।