নেতা ও শাসকের মধ্যে পার্থক্য আছে। শাসক সবসময় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মন জয় করতে সক্ষম না-ও হতে পারেন, কিন্তু নেতা জয় করতে পারেন। ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, কিন্তু দুইশ’ বছরেও জনমন জয় করতে পারেননি। সুলতানরা অনেকাংশে পেরেছিলেন। মোগলরাও। কারণ ভারতবর্ষের জনগণকে তারা ‘অপর’ ভাবেননি, যা ভেবেছিল ইংরেজরা। সুলতান-মোগলরা জনমন কিছুটা জয় করতে পারলেও তারাও ছিলেন ইংরেজদের মতোই বহিরাগত, যেমন বহিরাগত ছিলেন বাংলার নবাবরা।
তাহলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম অবিসংবাদিত গণনেতা কে? প্রচলিত মতে বাঙালির ইতিহাস যদি হাজার বছরের হয়, তবে হাজার বছরের ইতিহাসে তেমন গণনেতার দেখা আমরা পাচ্ছি না। পাচ্ছি বিশ শতকে। সেই গণনেতা, গণনায়কের নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
জাতীয় শোক দিবসে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার কাণ্ডকারখানা দেখে বড়ই করুণা জাগে। করুণা জাগে এই জন্য যে, তারা জানেন না বঙ্গবন্ধু কে, জানেন না তাঁর কী অবদান। জানেন গথবাঁধা কিছু কথা। বক্তৃতায় সেগুলোই বলে বেড়ান। অনেক নেতাকে দেখতে পাই, ঠিকমতো যারা গথবাঁধা কথাগুলোও বলতে পারেন না।
সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের একটা কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল। তিনি যেদিন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে বললেন, ‘শোন, প্যান্ট-স্যুট পরা ভদ্রলোকদের তুই সামলাস। কিন্তু যারা গ্রাম থেকে আসে, লুঙ্গি পরা, ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, তারা যেন আমার দুয়ার থেকে ফিরে না যায়। তাদেরকে তুই আমার কাছে পাঠায়ে দিবি।’
তারা যে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করেন না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে যে লালন করেন না, তাদের প্রচার-প্রচারণা ও কথাবার্তা শুনলেই তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। সেদিন দেখলাম শোক দিবসের এক পোস্টারের উপরে বঙ্গবন্ধুর ছবি, নিচে প্রধানমন্ত্রীসহ এক ডজন নেতার ছবি, সবার নিচে এক ‘উঠতি নেতার’ বিশাল ছবি। এই পোস্টার যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধার পোস্টার নয়, তা দেখলেই বোঝা যায়। এসব পোস্টার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচারপত্র মাত্র।
এখনো বিস্তর বাঙালি ঠিকমতো বঙ্গবন্ধুকে বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁর অবদানকে স্বীকার করে নিতে এখনো অনেক বাঙালির কুণ্ঠা। সহজেই তারা বুঝতে পারতেন, বাংলাদেশ যদি আজ কোনো বড় রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রদেশ হয়ে থাকত। বুঝতে পারতেন, বাংলাদেশের ওপর যদি কোনো বহিঃরাষ্ট্রের উপর্যুপরি চোখ রাঙানি থাকত। যেমন ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনের মানুষেরা জানেন ইয়াসির আরাফাত কে। খুব গভীরভাবে বোধ করেন একজন ইয়াসির আরাফাতের শূন্যতা।
সেদিন পাঠক সমাবেশে ‘মঙ্গল সমাবেশ’-এর আড্ডায় সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের একটা কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল। তিনি যেদিন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে বললেন, ‘শোন, প্যান্ট-স্যুট পরা ভদ্রলোকদের তুই সামলাস। কিন্তু যারা গ্রাম থেকে আসে, লুঙ্গি পরা, ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, তারা যেন আমার দুয়ার থেকে ফিরে না যায়। তাদেরকে তুই আমার কাছে পাঠায়ে দিবি।’
কথাটা খুব ইঙ্গিতবাহী। একজন গণনেতার বৈশিষ্ট বোঝার জন্য এই উক্তিটি যথেষ্ট। প্রত্যেক জাতিতেই এমন একজন নায়ক আসেন। যেমন মহাত্মা গান্ধী, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা। বাঙালিদের জন্য এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হুট করেই গণনেতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। নির্বাচনে জিতেও ক্ষমতা না পেয়ে তিনি নেতা হয়ে উঠেছেন।
ভুল। বঙ্গবন্ধুর উত্থান হুট করে হয়নি। এমন গণনায়কের উত্থান হুট করে হয় না। সেই উত্থানের পেছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যে গণনেতা হয়ে উঠলেন তার পেছনেও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। চল্লিশের দশক থেকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো পড়লে বোঝা যায় তিনি কীভাবে নেতা হয়ে উঠছেন। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ পড়লে জানা যায় তাঁর অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মূল্যায়নটুকু গুরুত্বপূর্ণ। কদিন ধরে ডুবে আছি তাঁর আত্মজীবনী ‘জগৎ কুটিরে’। অমর্ত্য সেন এই বইতে লিখেছেন, “…এখানে যোগ করতেই হয় বাংলাদেশের মহান রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের—বঙ্গবন্ধুর—কথা। তাঁরই নেতৃত্বে বিকাশ ঘটেছিল এক শক্তপোক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির।…ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণাটির পক্ষে গঠনমূলক রাজনীতি গড়ে তোলা খুবই জরুরি ছিল। অনেক বছর ধরে, বহু বাধা কাটিয়ে তা করাও গিয়েছিল। শেষাবধি যে সুদূরপ্রসারী এবং সদর্থক লক্ষ্য নির্মানের প্রয়োজন ছিল, তা তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।”
বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত গণনায়ক ছিলেন বলেই তাঁর মধ্যে ছিল পিতৃত্বের গুণাবলী। পিতা যেমন পুত্রদের স্নেহবশত ‘তুই’ বা ‘তুমি’ সম্মোধন করেন, বঙ্গবন্ধুও তাই করতেন। বড় বড় আমলাদেরও অবলীলায় তিনি ‘তুই’ সম্মোধন করতেন। সাতই মার্চের ভাষণে আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে বলছেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
এই ভাষণে তিনি জনগণকে একাধিক বার ‘তুমি’ সম্মোধন করেছেন। এমন সম্মোধন তাঁর আগে আর কোনো বাঙালি নেতা করেননি, করতে পারেননি, সাহস পাননি। পরেও না। এখন কোনো নেতা জনগণকে তুমি সম্মোধন করবেন, তা তো ভাবাই যায় না।
তাঁর মধ্যে পিতার গুণবালী ছিল বলেই ১৫ আগস্টে হন্তারকরা যখন তাঁর সামনে দাঁড়াল, তখন তিনি বলেন, ‘তোরা কি চাস? তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি, বেয়াদবি করছিস কেন? তোরা কি আমাকে খুন করতে চাস? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোরা কি মনে করিস তা করতে পারবি?’
তাঁর সেই ‘তুই’ সম্মোধনের কাছে নতজানু হয়ে পড়েছিল খুনী মহিউদ্দিন। তাঁর পর্বতসমান ব্যক্তিত্বের কাছে রীতিমতো নার্ভাস হয়ে পড়েছিল খুনী নূর চৌধুরী ও বজলুল হুদা। সেই নার্ভাসনেস কাটাতেই তাদেরকে খরচ করতে হলো ১৮টি গুলি। কোনো মানুষকে হত্যা করতে কি এত গুলির দরকার হয়? হয় না। ১৮টি গুলিই হচ্ছে নূর ও হুদার মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ।
বঙ্গবন্ধুর মতো গণনেতা পেতে বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সহস্র বছর। আগামী সহস্র বছরে আবার এমন একজন নেতা আসবেন কিনা সন্দেহ। আমি বাঙালি। আমার জন্ম আমেরিকায় হলে আব্রাহাম লিংকনকে নেতা হিসেবে মান্য করতাম। আমার জন্ম চীনে হলে মাওসেতুংকে নেতা হিসেবে মান্য করতাম। আমার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় হলে নেলসন ম্যান্ডেলাকে নেতা মান্য করতাম। আমার জন্ম ফিলিস্তিনে হলে ইয়াসির আরাফাতকে নেতা মান্য করতাম।
যেহেতু আমি বাঙালি, যেহেতু আমার এই পরিচয় মুছে দেওয়ার উপায় নেই, যেহেতু বাঙালি পরিচয়ে আমার মধ্যে কোনোরূপ হীনম্মন্যতা নেই, যেহেতু আমি একজন রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতন বাঙালি লেখক, সেহেতু ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি নেতা হিসেবে মান্য করি। তিনি না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি আমার কাছে অস্তিত্বমান। জাতীয় শোক দিবসে তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
- স্বকৃত নোমান। কথাসাহিত্যিক।