বড় ভাইয়ের সার্টিফিকেট দিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে পুলিশে চাকরি করছেন এক ব্যক্তি। কনস্টেবল পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি এএসআই পদে কর্মরত রয়েছেন মৌলভীবাজার জেলায়। তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার নাম মোবারক হোসেন মজুমদার। তিনি পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে ২০০৩ সাল থেকে চাকরি করছেন।
এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশ অধিদপ্তরের নির্দেশে সুনামগঞ্জের সহকারী এক পুলিশ সুপার তদন্ত শুরু করছেন। এ ঘটনায় সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরে করা লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার দোয়াবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ঝুমগাঁও ইসলামপুর গ্রামের মৃত মোক্তল হোসেন মজুমদারের ৫ ছেলে ও ৫ কন্যাসন্তান রয়েছে। তার প্রথম ছেলে বাবুর্চি রুস্তম মজুমদার, দ্বিতীয় ছেলে স্কুলশিক্ষক মিজান মজুমদার, তৃতীয় ছেলে পল্লী চিকিৎসক মোশাররফ হোসেন মজুমদার, পুলিশের এএসআই পদে চাকরিরত চতুর্থ ছেলে মোবারক হোসেন মজুমদার এবং পঞ্চম ছেলে শ্রমিক মোতালিব হোসেন মজুমদার।
বর্তমানে তার তৃতীয় ও চতুর্থ দুই ছেলের নাম এখন মোশারফ হোসেন ও মোশারেফ হোসেন মজুমদার। ব্যবধান শুধু একটি বর্ণের। এদের মধ্যে বড় ভাই মোশাররফ হোসেন মজুমদার থেকে মোশারেফ হোসেন মজুমদার হয়েছেন। তার ছোট ভাই মোবারক হোসেন মজুমদার থেকে হয়েছেন মোশাররফ হোসেন। মোবারক থেকে মোশাররফ হোসেন হয়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে পুলিশে বড় ভাইয়ের নামে চাকরি করছেন ছোট ভাই।
ছোট ভাইয়ের চাকরির সুরক্ষা দিতে বড় ভাই মোশাররফ তার নামের একটি বর্ণ পরিবর্তন করে বংশগত টাইটেল যুক্ত করে মোশারেফ হোসেন মজুমদার নাম ধারণ করেছেন। যদিও বর্তমানে এনআইডির তথ্য অনুসারে মোবারক এখন পুলিশের এএসআই মোশাররফ আর মোশাররফ এখন মোশারেফ নাম পরিবর্তন করেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্যমতে, ছোট ভাই মোবারকের চাকরির সুরক্ষা দিতে ২০১৭ সালে এনআইডি সংশোধন করে মোশাররফ থেকে মোশারেফ করা হয়েছে। এনআইডি সংশোধনের পূর্বে ২০১৬ সালে মোশারেফ ভোটার তালিকা অনুযায়ী মোশাররফ ছিলেন। এমনকি তার স্ত্রী তাসলিমা বেগমের এনআইডিতে স্বামীর কলামে রয়েছে মোশাররফের নাম। তার মাদ্রাসা পড়ুয়া মেয়ে ইসরাত জাহান এনীর ভর্তি তথ্যে বাবা মোশাররফই রয়ে গেছে।
এ ছাড়া স্থানীয় হকনগরবাজার ব্যবসায়ী কমিটির তালিকা, সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদপ্রার্থীর পোস্টারে ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের তালিকায় যুগ্ম আহ্বায়কসহ বিভিন্ন তালিকায় তিনি মোশাররফ নামেই ছিলেন।
এনআইডির তথ্যমতে, তিনি মোশাররফ নামে চাকরি করলেও ২০০০ সালে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দোয়ারাবাজারের বোগলা রুসমত আলী উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে কলেজ) থেকে ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন মোক্তল হোসেনের চতুর্থ ছেলে মোবারক হোসেন। যার রোল নম্বর ১০৮৮৬৬ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৩৩১০৮৬। সনদে জন্ম তারিখ ১২ মার্চ ১৯৮২।
তার বড় ভাই মোশাররফ হোসেন ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ঢাকার অধীনে ভুটুয়া শ্রীপুর ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা আনন্দপুর কুমিল্লা থেকে অংশ নিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে দাখিল পাস করেন। যার রোল নম্বর ১২২৫৭৮ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৭৫২৫৯। সনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৩ জানুয়ারি ১৯৮৪। বয়স অনুযায়ী মোবারক ছোট হলেও সনদ অনুযায়ী মোশাররফ মোবারকের দুই বছরের ছোট।
পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুই ভাইয়ের একই নামের ভয়ঙ্কর জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে তদন্তে মাঠে রয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার (জগন্নাথপুর সার্কেল) শুভাশীষ ধর।
দুই ভাই এখন মোশাররফ ও মোশারেফ মজুমদার। প্রশ্ন হলো— মোবারক নামের এসএসসি পাস সনদের সেই ব্যক্তি এখন কোথায়? মোশাররফ হোসেন নামে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে পুলিশের চাকরি করলেও এলাকায় মোবারকের বড় ভাই ডাক্তার মোশাররফ নামে পরিচিত ওই ব্যক্তি কে? নামের একটি বর্ণ পরিবর্তনের সঙ্গে লুকিয়ে আছে রহস্য ও জালিয়াতি অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোবারক ২০০১ সালে পুলিশে ভর্তি হলেও অনিবার্য কারণে ট্রেনিংয়ে অংশ নেননি। পরে তিনি পুলিশে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলে নিজ সনদে নির্ধারিত বয়স থেকে বেশি হওয়ায় বড় ভাই মোশাররফের সনদ ও নাম ব্যবহার করে ২০০৩ সালে পুলিশে যোগ দেন মোবারক। মোশাররফ হোসেন ওরফে মোবারক মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের অধীনস্থ একটি পুলিশ ফাঁড়িতে এএসআই পদে কর্মরত আছেন।
চাকরিতে যোগদানের পর ২০০৭ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের সময় নিজের ফিঙ্গার দিয়ে এনআইডিতে স্থায়ীভাবে তিনি মোবারক থেকে মোশাররফ বনে যান।
তার চাকরির ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও এলাকাবাসী তার নাম মোশাররফ বলে কখনো শোনেননি। তাকে মোবারক ও তার বড় ভাই পল্লী চিকিৎসক মোশাররফ নামে জানেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে হকনগরবাজারে গেলে পুলিশ কর্মকর্তার বড় ভাই বর্তমান মোশারেফ হোসেনের সঙ্গে তার দোকানে দেখা হয়। দোকানটির ভেতরে অনেকটাই খোলামেলাভাবে রাখা হয়েছে ওষুধ। যদিও তার দোকানের সাটারে লেখা রয়েছে ডেকোরেটার্স। এ যেন ডেকোরেটার্স ব্যবসার আড়ালে ওষুধ ব্যবসা। তাও ফার্মেসি ও ওষুধ ব্যবসার প্রয়োজনীয় কোনো ডকুমেন্টস তার কাছে নেই।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদির বর্তমান এনআইডির তথ্য অনুসারে তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মুখ ফুসকে প্রথমে পুলিশের নাম মোবারকই বলে ফেলেন।
অভিযুক্ত এএসআই মোশাররফ হোসেন ওরফে মোবারক তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন।
এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার জগন্নাথপুর সার্কেল শুভাশীষ ধর জানান, এএসআই মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর সেটির তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আরও অধিক তথ্যের জন্য তদন্ত চলমান রয়েছে।
সূত্র : যুগান্তর