বিনিয়োগের টাকা ফেরত না পেয়ে দেনায় জর্জরিত গাজী আনিস অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। সোমবার (৪ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান তিনি। দগ্ধ গুরুতর আহত গাজী আনিসের চিকিৎসা চলছিল জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) ভোরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
মনোরোগ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা কারও কাম্য নয়। নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি এভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এখন তার পরিবারকে এ ঘটনার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারক চক্রের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড সামনে চলে আসে। তারা সময়-সুযোগ মতো টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের পর চম্পট দেয়। এরকম প্রতারক থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।
বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে গাজী আনিসের বন্ধু তুহিন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালে হেনোলাক্স কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ফাতেমা আমিনের সাথে পরিচয় হয় আনিসের। পরে ফাতেমা আমিনের স্বামী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিনের সাথেও পরিচয় হয় তার। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের মধ্যে ব্যাপক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তারা একাধিকবার এক সাথে বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। আর এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়েই হেনোলাক্স কোম্পানিতে বিনিয়োগের কথা বলে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনিসের কাছ থেকে ওই দম্পতি বাগিয়ে নেয় ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা লভ্যাংশ পাওয়া যাবে এমন ভরসায় ২০১৮ সালে টাকাগুলো হেনোলাক্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের হাতে তুলে দেন আনিস। কিছুদিন লভ্যাংশ দেওয়ার পর এক পর্যায়ে টাকা দেওয়া এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তারা। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া আমলি আদালতে ২ জনকে আসামি করে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়, যা বিচারাধীন রয়েছে। পলাতক রয়েছে প্রতারক স্বামী-স্ত্রী।
তুহিন আরও বলেন, আনিসের বিনিয়োগের টাকার মধ্যে তার বন্ধু ও অন্য কয়েকজনের কাছ থেকে ধারে আনা টাকাও ছিল। সেসব পাওনাদারের চাপ বাড়ছিল। এতে করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন আনিস। ৭ দিন আগেও উনার সাথে কথা হয়— তখন জানিয়েছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করবেন। গত ২৯ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিনিয়োগ করা টাকা ফিরে পাওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার সহায়তা চান তিনি। কিন্তু প্রায় মাস খানেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনও টাকা আর ফেরত পাননি তিনি।
বিনিয়োগ করে টাকা ফেরত না পাওয়া এবং দেনা করে বিনিয়োগের টাকা জোগাড় করায় দেনাদারদের চাপের বিষয়ে গত ৩১ মে গাজী আনিস তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ২০১৮ সালে কলকাতায় হোটেল বালাজীতে একইসাথে অবস্থানকালে উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এককোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ছাব্বিশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে উনারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন এবং কয়েকবার উনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্থা ও ব্ল্যাকমেইল করেন এবং করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশ’সহ আমার ন্যায্য পাওনা তিনকোটি টাকার অধিক।
তিনি আরও লিখেন, আমি একজন ব্যবসায়ী এবং জীবনে প্রচুর রোজগার করেছি। আমার রোজগারের সবচেয়ে বড় অংশ স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ এবং অসহায় দুস্থ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। সেইসাথে নিজেও সুখী-স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং সৎ জীবনযাপন করেছি। আমি তিন কন্যা সন্তানের জনক। আমার বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মেজো মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ভীষণ মানসিক খরায় আমি উল্লেখিত তথ্যাদি উপস্থাপন করলাম। আমার সামনে বিকল্প পথ না থাকায় ফেসবুকেও সবাইকে জানালাম। আমি এই প্রতারক দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ করছি। সেইসাথে যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তারাও সোচ্চার হবেন বলে আশা করছি।
এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী মেখলা সরকার বলেন, যারা হতাশা সহ্য করতে পারেন না তারা যেকোনও সময় যেকোনও ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পিছপা হন না। ওনার সহ্যক্ষমতা কম ছিল। তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, যেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনা তার জীবনকে আরও জটিল করে তুলেছে। যার প্রভাব তার পরিবার এবং স্বজনদের উপর গিয়ে পড়বে।
প্রকাশ্যে এ ধরনের আত্মহননের ঘটনা সমাজে কী বার্তা দেয় এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, টাকা-পয়সা বিনিয়োগ করে অনেককেই প্রতারণার শিকার হতে দেখি। আর এসব টাকার লেনদেন যখন হয় তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে হয়, অনেক সময় কোনও ডকুমেন্ট থাকে না। এতে করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও আইনগতভাবে কিছু করার থাকে না।
তিনি আরও বলেন, প্রেসক্লাবের সামনে আনিস নামের যে ব্যক্তি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তাতে বলা যায়— মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তিনি এমন একটি আচরণ করেছেন। এরকম ব্যক্তি আমাদের সমাজে অনেক রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। আইনগত ভিত্তি কিংবা ডকুমেন্টস না থাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এরকম ঘটনা যদি বাড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সমাজে প্রতারণার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যা সমাজের জন্য কোনও সুখকর বার্তা নয়।