‘গলা সমান পানিতে হাঁটতে হয়েছে’

সুনামগঞ্জে ঘুরতে গিয়ে প্রবল বন্যায় চার দিন আটকে থাকার পর অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২১ শিক্ষার্থী অবশেষে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছেন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রবিবার (১৯ জুন) দিবাগত রাত ১২টার দিকে ঢাকায় পৌঁছান তারা।

সেনাবাহিনীর তিন সদস্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে পৌঁছে দেন। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন তাদের সহপাঠীরা। অনিশ্চয়তার শঙ্কা কাটিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরা বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন সবাই। দীর্ঘ যাত্রার ধকল থাকলেও, ওই ২১ জনের চোখে-মুখে তখন অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ফিরে আসার আনন্দ।

পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টির কারণে এক মাসের মাথায় আবারও বন্যার কবলে পড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। তবে এবছরের বন্যা ভয়াবহ। অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত অবনতি হয় পরিস্থিতির। ডুবে যায় অধিকাংশ রাস্তাঘাট-বাড়িঘর। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে দেখা দেয় বিদ্যুৎ সংকট। আর এর ফলে এক পর্যায়ে মোবাইল নেটওয়ার্কেও দেখা যায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়। পরিস্থিতি সামলাতে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। টানা বৃষ্টিতে বন্যা ছড়িয়ে পড়ে উত্তরাঞ্চলেরও বিভিন্ন জেলাতেও। সবশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১২টি জেলায় বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চার জেলার বন্যা পরিস্থিতি তীব্র।

এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থীর আটকে পড়ার ঘটনাও নজড়ে আসে সবার। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এই শিক্ষার্থীরা শোনালেন বন্যার ভয়াবহতার গল্প। তবে এই ক্রান্তিলগ্নেও মূলত তারা একে অপরের ভরসায় শক্তি জুগিয়েছেন। অপরিচিত পরিবেশ আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় যখনই কেউ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, অন্যরা সবাই মিলে তাকে চাঙ্গা করে তুলেছেন।

ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের একজন মারিয়া হাসিবা। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, এই ট্যুরটা আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। মৃত্যু, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা একদম কাছ থেকে দেখেছি। এই বিপদে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, আমরা একজন আরেকজনের সহায় ছিলাম। জীবনের অনেক সুন্দর কিছু সময় কাটিয়েছি, আবার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হয়েছি। সবসময়ই বেঁচে ফেরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেখানে পরবর্তী এক মিনিটের নিশ্চয়তা ছিল না, যেকোন সময় মৃত্যু হতে পারে এটা ভেবেও নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জানি না, এতোটা মেন্টাল স্ট্যাবিলিটি আমি বা আমরা সেসময় কীভাবে অর্জন করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত তিন দিন কষ্ট হয়েছে শুধু ঘুম আর কাপড়ের জন্য। সম্পূর্ণ ভেজা কাপড় গায়ে শুকিয়েছে, ঠাণ্ডা বাতাসে বরফঠাণ্ডা হয়ে গেছে শরীর। তারপরও একটু ঠাণ্ডা লাগেনি এটা আল্লাহর রহমত। যেখানে আমার গলা সমান পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়েছে, স্রোত এতো বেশি যে যেকোনও সময় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে; এর মধ্যেও আমরা স্থির থেকেছি।’

আটকে পড়ার শুরু থেকেই তাদের অবস্থা গণমাধ্যম, প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছিলেন শোয়াইব আহমেদ। ফিরে আসার ঘটনার আদ্যপান্ত বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, গত ১৪ জুন টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার পর ১৬ তারিখ প্রথম বিপদ অনুভব করি। প্রবল নদী স্রোতের কারণে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা পর হাওর থেকে কূলে উঠে আসতে সক্ষম হই। এরপর সেখান থেকে ট্রলার যোগে সুনামগঞ্জ পৌঁছাই। ট্রলারে যে পথ পার হতে একঘণ্টা লাগার কথা, সেখানে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। কিছুক্ষণ পরপরই নদীর স্রোতের কারণে মাঝি পথ হারিয়ে ফেলছিলেন।

সুনামগঞ্জে আসার পথে এই তিনঘণ্টা অভিজ্ঞতা বর্ণনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল বলে জানান এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘এসময় এতো ভারী বর্ষণ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গুলি হচ্ছে। কোনোমতে সেখানে পৌঁছে পানসী নামে একটি হোটেলে আমরা আশ্রয় নিই। ওইদিনই রাতেই ১১টায় ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বন্যার পানির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকার সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।’

পরে সেখানকার সুনামগঞ্জ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পানসী হোটেলের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তবে শিক্ষার্থীদের রাতের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। শোয়াইব বলেন, ‘দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকলো পানি। সন্ধ্যায় যেখানে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানি ছিল, সকাল হতে হতে সেখানে গলা পানি। পরে র‌্যাব এসে আমাদের পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘উদ্বেগ, ভয় আর উৎকণ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খাদ্যসংকট। পুলিশ লাইন্সে গিয়ে আমাদের যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল খাবার ও ঘুম; সেটার ব্যবস্থা হয়। পরদিন ১৮ জুন সকালে স্থানীয় পুলিশ সুপার লঞ্চ ভাড়া করে আমাদের তুলে দেন।

শোয়াইব বলেন, ‘এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে এই লঞ্চ জার্নি। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর আমরা ছাতক এসে পৌঁছাই। পরে সেনাবাহিনী উদ্ধার করে আমাদের ঢাকায় পৌঁছে দিলো।’

আজমল হোসেনে প্রান্ত নামে আরেক শিক্ষার্থী এ ঘটনায় এতোটাই বিমর্ষ যে তিনি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছিলেন না। কিছুটা থেমে তিনি বলেন, ‘দুর্যোগের পুরোটা সময় আমরা নিজেরাই একে অপরের প্রথম অবলম্বন ছিলাম। যখনই কেউ ঘাবড়ে গিয়েছে, আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছে; আমরা তাকে মানসিক শক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’

সুনামগঞ্জের বন্যায় ২১ জন মূলত তিনটি স্পটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন বলে মনে করেন টিমের আরেক সদস্য মো. রাফিজ খান। তিনি বলেন, ‘এই তিনটি স্পটের প্রথমটি বিশ্বম্ভরপুর, দ্বিতীয়টি চালবন ও তৃতীয়টি দোয়ারাবাজার। তিনটি ধাপেই আমরা দলগতভাবে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছিলাম। একইসঙ্গে আমাদের শিক্ষক, সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই আমাদের মোবাইল ফোনে সাহস জুগিয়ে ও সহযোগিতা করে যাচ্ছিলেন। তবে বন্যার ভয়াবহতা ও সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি এতটাই বাজে ছিল যে, আমাদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল ও নিজেদের জীবন নিয়ে সংশয়ে ছিল।’

অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, অনেকেই জীবনের শেষ দিন ভেবে পরিবার প্রিয়জনের সাথে শেষ কথা বলে নিচ্ছিল বলেও জানান তিনি। তার কথায়, ‘অবশেষে সবার একান্ত প্রচেষ্টা ও সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা ২১ জনই অক্ষতভাবে ঢাকায় ফিরেছি এবং প্রতিটা সময় একে অপরকে সাহস জুগিয়েছি। এত বাজে সিচুয়েশনের মধ্যে থেকেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা ফিরতে পারায় মনে হচ্ছে যেন, নতুন করে জীবন পেয়েছি। অনেকেই নিজ নিজ পরিবার, প্রিয়জন ও জীবনের মূল্যকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।’

‘ঘরে (ক্যাম্পাস) ফেরা শিক্ষার্থীরা উদ্ধারকাজে জড়িত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‍্যাবের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের প্রতিও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন