তিন মাস পর দেশে আবারও ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যান। গত কয়েকদিন ধরে করোনা শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকা শহরে অবস্থান করছেন। এছাড়া সারা দেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে আক্রান্তের তুলনায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আরেকটি নতুন ঢেউ চলে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে করোনা আক্রান্তের হার ছিল একদিনে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ। সেদিন শনাক্ত হয়েছিল ১৫ হাজার ৪৪০ জন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে শনাক্তের হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতা ছিল জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর আবারও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। ৬ জুন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১ শতাংশের নিচে থাকলেও ৭ জুন থেকে ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আড়াই মাস পর ১২ জুন একদিনে শতাধিক শনাক্ত হয়। ৭ জুন থেকে এ পর্যন্ত ৯ দিনে শনাক্ত হয় ৮৮৩ জন। এরমধ্যে ১৫ জুন একদিনে দুই শতাধিক শনাক্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, জানুয়ারিতে শনাক্ত ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৪৪ জন, মার্চে ৮ হাজার, এপ্রিলে ১ হাজার ১১৪ জন এবং মে’তে ৮১৬ জন। আর জুন মাসের ১৫ দিনেই শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৫৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ জুন শনাক্ত হওয়া ২৩২ জনের মধ্যে ২১৬ জনই ঢাকা শহরে অবস্থান করছেন। এর আগের দিন শনাক্ত ১৬২ জনের মধ্যে ১৪৯ জনই ঢাকা মহানগরীর। গত সাত দিনে ৭৫৯ জন শনাক্ত হয়েছে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতে।
হাসপাতাল পরিস্থিতি বলছে, ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার ৯৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে বর্তমানে ৩ হাজার ৮০টি খালি আছে। আর ৩৫১টি আইসিউ’র মধ্যে ৩৪৩টি খালি। ৪১৩টি হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) মধ্যে ৪১০টি খালি আছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে আবারও ধীর ধীরে করোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের করোনা শনাক্তের হার হাফ পার্সেন্ট ছিল। এখন সেটা প্রায় ২ শতাংশে উঠে গেছে। সংক্রমণের হার যেটা ছিল, তাতে প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন করে সংক্রমিত হতো। এখন সেটি শতাধিক। আমি মনে করি, টেস্ট বেশি করালে সংক্রমণের হার আরও বেশি পাওয়া যাবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভালো আছি, আমাদের হাসপাতালে তেমন রোগী নেই। সারা দেশের হাসপাতালে এখন ২০ জন রোগীও নেই। আশার বিষয়, কোনও মৃত্যু নেই। কিন্তু সংক্রমণের হার যদি বেড়ে যায় হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বাড়বে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। সেজন্য আমি সবাইকে বলবো— স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কাজ করতে। মাস্ক পরতে হবে, হ্যান্ড সেনিটাইজ করতে হবে, সামাজিক দূরত্ব যতটুকু সম্ভব, বজায় রাখা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন মাস্ক পরি না। এখন তো আর সামাজিক দূরত্ব নাই। সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। স্কুল, কলেজ, বাজারে কাজকর্ম সব আগের নিয়মে চলে এসেছে। সেজন্য করোনা কিছুটা বাড়তি। পাশপাশি বিভিন্ন দেশে করোনা বাড়ছে। এটাও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিভিন্ন দেশ থেকে লোক আসে, তারা করোনা নিয়ে আসে। তারা টিকাপ্রাপ্ত, ফলে আরটি পিসি আর টেস্ট করা লাগে না। সেজন্য আমরা ডিটেক্ট করতে পারি না। ওটার কারণে করোনা কিছুটা বাড়তে পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদি দেখি, অন্যান্য দেশে আরওে বাড়ছে, তাহলে আগের সেই টেস্ট করে আসার নিয়ম আবার জারি করা হবে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের এক ঢেউ থেকে আরেক ঢেউয়ের লক্ষণ তিন মাস পর দেখা দেয়। অন্যান্য দেশে যারা খুবই কড়াকড়ি আরোপ করে থাকে, তাদের হয়তো ছয় মাস পর দেখা দেয়। আমরা তো আর স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে পারছি না, অনেক কারণেই।’
তিনি বলেন, ‘যারা একবার সংক্রমিত হয়, তারা সাধারণত পুনরায় সংক্রমিত হতে পারে তিন মাস পর, যদি নতুন ভ্যারিয়েন্ট না আসে। এখন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু টিকা নিলেও সংক্রমিত করছে। সাধারণত টিকা নেওয়ার তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত একটা সুরক্ষা পাওয়া যায়। সিভিয়ারিটি থেকে রক্ষা পেলেও সংক্রমিত হওয়া থেকে বাদ যায় না। এক ঢেউ থেকে আরেক ঢেউয়ের মাঝখানে ৩ মাস বিরতি থাকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে না পারলে, সেই লক্ষণ দেখা দেয়। এখন আমরা তাই দেখছি, খুবই শিথিল অবস্থা। সংক্রমণ এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কাজেই একটা নতুন ঢেউয়ে আমরা প্রবেশ করেছি। এখন যেহেতু টিকার আওতায় অনেকেই এসেছেন, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো কম হবে। যার ক্ষয়ক্ষতি হবার তার তো হবেই, তারপর আবার কোভিড পরবর্তী একটা জটিলতা থাকবে। সুতরাং, যারা টিকা নেয়নি এখনো, তাদের অবশ্যই টিকা নিতে হবে।’