সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহ পেরিয়েছে মাত্র। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ঝরেছে ৪৮টি তাজা প্রাণ। এরপরও অগ্নিকাণ্ড থেমে নেই, গেল সপ্তাহজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই মিলেছে আগুনের খবর। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব দুর্ঘটনার সবগুলোই ঘটেছে হয় কারখানায়, নয়তো যানবাহনে। বাস থেকে শুরু করে বাদ যায়নি ট্রেন এবং ফেরিও। প্রশ্ন উঠছে— একের পর এক এসব অগ্নিকাণ্ড কি কেবলই অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা, নাকি এতে নাশকতার যোগসূত্র রয়েছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘দুটো দিকই মাথায় রেখে সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ আর শ্রমিক নেতারা বলছেন, ‘এসব দুর্ঘটনায় ক্ষমতার বিপরীতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রমিকদের মৃত্যুর বিচার না হওয়ায় বছরের পর বছর কারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলছে।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সময় পরপর ১৫ থেকে ২০টি কন্টেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। সেসময় প্রতিটি কন্টেইনার একেকটি শক্তিশালী বোমায় পরিণত হয়। ওই ঘটনায় চার শতাধিক মানুষ দগ্ধ হয়েছেন। আর এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৮ জনের। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ১০ কর্মীও রয়েছেন।
কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে ৪ জুন রাত ৯টার দিকে। আগুন তখনও নেভেনি, এরই মধ্যে ৫ জুন (রবিবার) পাবনার বেড়া উপজেলায় পাঠকাঠির কারখানায় আগুনের খবর আসে। পরেরদিন ৬ তারিখ আগুনের কোনও খবর না পাওয়া গেলেও ৭ জুন সোমবার মোহাম্মদপুরের বসিলায় একটি জুতার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে ৮ জুন মঙ্গলবার চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় এবং রাজধানীর পোস্তগোলায় চিপসের কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। ১০ জুন রাজধানীর নর্দা এলাকায় তুরাগ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগে। পরেরদিন ১১ জুন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চলন্ত ট্রেনে এবং শিমুলিয়া ঘাটে যাত্রী ও যানবাহন ভর্তি একটি ফেরিতে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। সবশেষ গতকাল রবিবার (১২ জুন) আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়।
হঠাৎ করে কেন আগুনের ঘটনা বাড়ছে প্রশ্নে বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের বড় বড় আগুনের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত’ কারণ বিষয়টি বারবার দেখা যাওয়ার পরেও বিচারের মুখোমুখি করতে দেখা যায়নি। বিচারহীনতার কারণে যারা দায়ী তারা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ফলে যেকোনও দুর্ঘটনা এড়াতে তার যেসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তা তারা নেয় না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান মনে করে ধারাবাহিকভাবে এধরনের অগিকাণ্ডের কারণ হিসেবে নাশকতা একটি কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে দুধরনের বিষয় ঘটে থাকে। এক অবহেলাজনিত ও আরেক নাশকতামূলক। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিটা ক্ষেত্রে দায়িত্বের জায়গায় একধরনের অবহেলা লক্ষ্য করা যায়। কন্টেইনারে কী বস্তু থাকবে এবং সেটা কীভাবে রাখা হবে; তা নিয়ে কোনও মনিটরিং থাকবে না- তা তো হতে পারে না। কেননা সেই অনুযায়ী সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা।’
বিচারহীনতাকে কারখানায় ঘনঘন অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তাজরীন ফ্যাশন বলেন, পুরান ঢাকার নিমতলী বলেন; সবখানেই আগুনের পেছনে মালিকপক্ষের অবহেলা ছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পুরান ঢাকা থেকে এখনও কেমিক্যালের গুদাম সরানো সম্ভব হয়নি। একজন মালিককেও তার কাজের (অবহেলা) জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফলে সবচেয়ে দুর্বল হিসেবে শ্রমিকসমাজ বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে, হচ্ছে। নামমাত্র ক্ষতিপূরণেই চুপ থাকতে হচ্ছে তাদের। আর অন্যরা ঝুঁকি নিয়েই আবার নেমে পড়ছেন জীবনযুদ্ধে। আসলে তাদের জন্য কথা বলার কেউ নেই।’
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন