দেশজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অন্যায্য দাবির প্রতিবাদে ‘সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত’ গাওয়ার আয়োজন করেছিল বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
ফেসবুকে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখে এই আয়োজনে একাত্মতা জানিয়েছিলেন সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নে এই আয়োজনটি অবশেষে স্থগিত করা হয়েছে।
শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আয়োজকদের পক্ষে নাট্যকর্মী অরূপ বাউল তাঁর টাইমলাইনে করা এক পোস্টে এই আয়োজন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
অরূপ বাউল লিখেন, ‘জাতীয় সংগীত আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের অস্তিত্বের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’। গত ৫ সেপ্টেম্বর আমরা শহীদমিনারে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত গাইতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওইদিন নিরাপত্তাজনিত কারণে আয়োজনটি করতে না পেরে পরবর্তীতে ৬ সেপ্টেম্বর কাজী নজরুল অডিটোরিয়ামে করার উদ্যোগ নেই। সমবেত কন্ঠে আমার সোনার বাংলা গেয়ে জাতীয় সংগীত বদলানোর অন্যায্য দাবির প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু আমরা পারছি না।
এই উদ্যোগ নেওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিনীতভাবে নিরাপত্তা বিষয়ক সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। এছাড়া এই আয়োজনকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের আয়োজন বলে প্রোপাগান্ডা চালায় একদল মানুষ। এবং এই প্রোপাগান্ডার প্রেক্ষিতে তারা এই আয়োজনকে প্রতিহত করতেও উদ্যত হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের এই আয়োজন কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের আয়োজন ছিল না।
তাই শত শত কিংবা হাজারো লোকের নিরাপত্তার কথা ভেবে জাতীয় সংগীত গাইতে পারছি না। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করতে হচ্ছে।
যে তরুণ, যে যুবা, যে পরিণত বয়সের নাগরিক এবং যে জ্যেষ্ঠ নাগরিক আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, তাদের আবেগকে শ্রদ্ধা করছি, ভাবতে হয়েছে নিরাপত্তার কথা। আমাদের এই ব্যর্থতা মার্জনা করুন।
আমরা বাইরে গাইতে পারিনি জাতীয় সংগীত। আমরা বাইরে গাইতে পারছি না জাতীয় সংগীত। কিন্তু বাইরে না পারলেও একা একা তো পারব। যে যেখানে সেখানেই গাইব। ফেসবুক লাইভে গাইব। ভিডিও রেকর্ড করে নিজের গাওয়া জাতীয় সংগীত আপলোড করতে পারব। জাতীয় সংগীতের লাইনগুলো লিখে দিতে পারব ফেসবুকে।
বাইরে হয়ত প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাদের জড়ো হবে না, কিন্তু আমাদের গাওয়া জাতীয় সংগীত ছড়িয়ে পড়বে অন্তর্জালে।’
এদিকে, ৬ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তিত কর্মসূচি স্থগিত প্রসঙ্গে আয়োজকরা জানান, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহিদ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা, প্রাণের জাতীয় সংগীত। সংগ্রামী জনতা, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিগত ১৫বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দল আওয়ামিলীগ কিভাবে কতৃত্ববাদী কায়দায় দেশকে পরিচালিত করেছেন।
একদিকে ভোটারবিহীন রাজনীতি অপরদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশকে পর্যায়ক্রমে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলো। এই রকম দুঃসহ বাস্তবতায় দেশপ্রেমিক ছাত্রজনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে বীর শহীদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যে ফ্যাসিবাদের অবসান ও বৈষম্যের অবসানের কথা বলা হয়েছে, সেটি সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা, সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক ন্যায় বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
অথচ আমরা ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি, অনেকে সংবিধানের বিরোধিতা করতে যেয়ে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার বিরোধিতায় নেমেছেন। এই অপশক্তি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য আওয়াজ তুলছে। এই অপশক্তিকে দেশবাসী গ্রহণ করবে না। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত আমাদের প্রাণের স্পন্দন।
জাতীয় সংগীত অবমাননার প্রতিবাদে আমরা যখন সিলেট শহিদ মিনারের পাদদেশে ‘সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত’ কর্মসূচি গ্রহণ করি ঠিক তখন থেকেই অন্ধকারের আরেক ফ্যাসিস্ট শক্তি হুংকার দিয়ে উঠে। প্রশাসনসহ নানা জায়গা থেকে নানাভাবে কর্মসূচি স্থগিত করানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগ কায়দায় নানা অপপ্রচার শুরু করে। এহেন বাস্তবতায় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কর্মসূচি স্থগিত করি। কেননা এই কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা একজন সুনাগরিক হিসেবে মেনে নিতে পারি না।
আজ ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ শুক্রবারের কর্মসূচিটাও একই কারণে স্থগিত করা হয়েছে। এই কারণে আমরা দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। একইসাথে আমরা সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে একীভূত হওয়ার আহবান জানাই।
আমরা খুব শীঘ্রই আপনাদের সাথে নিয়ে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবো। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনা, লড়াই ও বিশ্বাসের অঙ্গীকার। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীশক্তি ও বহুরুপী দালাল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ীদের সামাজিক -সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।’