বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বিগত দিনের বৈঠকে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হলেও কার্যত বিভিন্ন সময় ঘটে চলেছে সীমান্তে হত্যা। গত ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার পিলখানায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে ৫২তম সীমান্ত সম্মেলনে যৌথ আলোচনার দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আবারও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার আশ্বাস দিয়েছে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তের অপরাধীরা সশস্ত্র থাকে, সে কারণেই আত্মরক্ষার্থে অনেক সময় গুলি চালানো হয়। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সীমান্তে ২০২ বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৪৩৮ জন। চলতি বছরের (২০২২) জুন পর্যন্ত সীমান্তে মারা গেছেন পাঁচ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২। ২০২০ সালে ছিল ৪৯ জন। ২০১৯ সালের সীমান্ত নিহত হয় ৩৫ বাংলাদেশি। ২০১৮ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল তিন জন। ২০১৭ সালে ২২ জন। ২০১৬ সালে ৩১ ও ২০১৫ সালে ৪৫ জন নিহত হয়।
বিএসএফের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের মাধ্যমে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। সীমান্তে নিহত হয়েছে ৮ জন। নন-লিথাল উইপেন ব্যবহার হয়েছে ১৫৭২ বার। ২০২১ সালে প্রাণঘাতী অস্ত্রের মাধ্যমে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১৪টি। ২০২০ সালে ঘটে ২৬৮টি। সীমান্তে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিএসএফের ১৪ সদস্য আহত হয়। ২০২১ সালে আহতের সংখ্যা ছিল ৪৯ জন।
১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পিলখানায় ৫২তম মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে বিজিবি ও বিএসএফ কর্মকর্তারা। বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিংয়ের নেতৃত্বে ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশ নেন। অপরদিকে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যৌথ নদী কমিশন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, সার্ভেয়ার জেনারেল অব বাংলাদেশ এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরাসহ ২০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশ নেয়।
সম্মেলনে, সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা, আহত ও মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অধিকতর কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে সীমান্তে যৌথ দহল জোরদার, বিশেষ করে রাতে টহল পরিচালনার বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে। সীমান্তে মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা পাচার, আগ্নেয়াস্ত্র, জালমুদ্রা, স্বর্ণ চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে উভয় বাহিনী তথ্য আদান-প্রদানে সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন, অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানবপাচার, সীমান্ত পিলার ও উপড়ে ফেলা সীমান্ত অপরাধীদের কাছ থেকে স্থানীয় জনগণকে দূরে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও সম্মত হয় উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এছাড়া, ভারত থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে ভারতীয় দালালদের মাধ্যমে এ বিষয়টি বিএসএফ মহাপরিচালকের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এবং দালাল চক্রকে খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তুলে ধরা হয় বিজিবির পক্ষ থেকে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ বলেন, বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের খোলামেলা আলোচনা হয়েছে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কিভাবে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা যায় সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সীমান্তে কোন হত্যার ঘটনা ঘটলে সেখানে নিহত ব্যক্তির পরিবার সাফার করে। সীমান্ত হত্যার মতো ঘটনা ঘটলে পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিএসএফ কর্মকর্তারা এর গুরুত্ব বুঝেছেন। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার জন্য সম্মত হয়েছেন তারা। শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনতে যৌথভাবে কাজ করা হবে।
বিএসএফের মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং বলেন, সীমান্তে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তারা অপরাধী। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের অপরাধী বলছি। মানবাধিকার অক্ষুণ্ন রেখে বিএসএফ সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিজিবি বিএসএফ বিভিন্ন পর্যায়ে এবং মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে আশ্বাসের পরেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, সীমান্ত এলাকার উভয়পাশেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সেগুলো থেকে যে ভীতির সৃষ্টি হয় তাতে লিথাল উইপেন ব্যবহার হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে মাঠ পর্যায়ের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করতে হবে লিথাল উইপেন ব্যবহার যেন না করতে হয়। সীমান্ত হত্যার মূল কারণ হচ্ছে বর্ডারে অবৈধ চলাচল। সেই চলাচল যদি বন্ধ করা যায় তাহলে লিথাল উইপেন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না।