সিরাজগঞ্জের ৪৩ বছর বয়সী ইউসুফ এই বছরের শুরুতে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কুকুরের কামড় খেয়েছিলেন, তবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়ে যায় পরিবারের। আর তাতেই বিপদ বেড়ে তিনি মারা যান। চিকিৎসকদের মতে, জলাতঙ্কের উপসর্গ এবং লক্ষণগুলো রোগের শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে এনসেফালাইটিস সৃষ্টি করে এবং এরপরই মৃত্যু ঘটে।
দেশে ২০১০ সালের আগে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেন। গবাদিপশুর মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান অজানা হলেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এই রোগে মারা যেতো। ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে।
চিকিৎসকরা জানান, জলাতঙ্ক রোগ শুধু কুকুর কামড়ালেই হয় না। বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেও এই রোগ হতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পানিভীতি, আলোভীতি, বায়ুভীতি হলেও এর শেষ পরিণতি মৃত্যু। তবে এই রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। যদি কোনও প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি, শিয়াল কামড় বা আঁচড় দেয়, সঙ্গে সঙ্গে সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান ১৫ মিনিট ধুতে হবে এবং সময়মতো জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আজ বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জলাতঙ্ক: মৃত্যু আর নয়, সবার সঙ্গে সমন্বয়’। এই প্রতিপাদ্যে প্রধানত জলাতঙ্ক, মৃত্যু ও সমন্বয়- এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জলাতঙ্ক প্রাচীনতম সংক্রামক রোগের একটি। তাই প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংগঠনের পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে জলাতঙ্কে মৃত্যুর হার শূন্যে আনা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, বাংলাদেশ সরকারের নানাবিধ স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ কমে এসেছে। অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ৩০০টির বেশি জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকায় মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ৫টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে কুকুর বা অন্যান্য প্রাণীর কামড়/আঁচড়ের আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী আরআইজি দেওয়া হচ্ছে। সরকার প্রতি বছর প্রায় তিন লাখের বেশি জলাতঙ্ক সংক্রমণকারী প্রাণীর কামড়/আঁচড়ের রোগীকে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করছে। এর ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে।
জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শতকের ঘর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা নিচের দিকে নামছে। ২০১৪ সালে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়েছে ১০৬ জন, ২০১৫-তে ৮৩ জন, ২০১৬-তে ৬৬ জন, ২০১৭-তে ৮০ জন, ২০১৮ ও ২০১৯-এ ৫৭ জন, ২০২০ সালে ২৬ জন, ২০২১ সালে ৪০ জন এবং ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত ৩১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ১১ জন শিশু। বয়স্ক ব্যক্তিও আছেন এদের মধ্যে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ এক সপ্তাহে দেওয়ার ফলে রোগীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এর পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রাণিদেহে জলাতঙ্কের জীবাণু ল্যাবে নিশ্চিতকরণের কাজ করে চলেছে। এতে নির্দিষ্ট স্থানে এই রোগের উপস্থিতি ও প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করে মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপক হারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপক হারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে ইতোমধ্যে ৬৪টি জেলায় প্রথম রাউন্ড, ১৭টি জেলায় দ্বিতীয় রাউন্ড এবং ৬টি জেলায় তৃতীয় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২২ লাখ ৫১ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে। যা মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এরমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, জলাতঙ্ক রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তাই কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্যান্য প্রাণী কামড় কিংবা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে যদি ১৫ মিনিট সেই জায়গা ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ধোয়া হয় তাহলে কিন্তু সংক্রমণের শঙ্কা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কমে যায়। আর কামড় দিলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কামড়ের জন্য তার টিকা নেওয়ার প্রয়োজন আছে, আবার কামড়ের ফলে যদি রক্তপাত হয় তাহলে তাহলে টিকার সঙ্গে আরেকটি আরআইজি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক কিংবা কবিরাজের কাছে কিংবা নিকটস্থ ফার্মেসিতে চিকিৎসা না নিয়ে নিবন্ধিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আমাদের এখানে এই বছর ৬০ হাজার ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, যার বেশিরভাগই কুকুরের কামড়ের। আর গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৬৪ হাজার ৬৬২ জন। প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৩৫০ রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জুনোটিক ডিজিজ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এস এম গোলাম কায়সার বলেন, কুকুর কিংবা বিড়াল জাতীয় প্রাণীর কামড় খাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতালে গিয়ে টিকা নিতে হবে। সরকার বিনামূল্যে এই টিকা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক ও কবিরাজি চিকিৎসা থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি আরও জানান, দেশের কোথাও এই টিকার সংকট নেই।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন