মহান বিজয় দিবস ২০২৪

৭১ এর ডলুরা, মধু মিয়া এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা

ডলুরা সমাধিসৌধ।

অশ্রু আর রক্তে সিক্ত মাটির বুকে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এ মাটিতে বিজয়ে উল্লাসের সাথে মিশে আছে গভীর শোক, বেদনা। কোন কোন অধ্যায় বারবার আলোচ্য, আবার কতকিছু চাপা পড়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।

তেমনি জাতীয় পর্যায়ে প্রায় বিস্মৃত সুনামগঞ্জের ডলুরায় ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্মগাঁথা। এখানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মিত সৌধ ধারণ করে আছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, এখানে একই মাটিতে মিশে আছেন হিন্দু ও মুসলিম।

ভারত সীমান্তের লাগোয়া সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ডলুরা সমাধিক্ষেত্র। এখানে ৪২ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন এবং ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাহ করার পর সমাধিস্থ করা হয়েছে।

আর এ সমাধিসৌধের সাথে জড়িয়ে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মধু মিয়ার নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আনসার কমান্ডার মধু মিয়া অনুভব করেন শহীদদের সমাধিস্থ করার প্রয়োজনীয়তা। নিজ গ্রাম ডলুরায় এক একর ৬০ শতাংশ ভূমিতে একে একে সমাধিস্থ করেন শহীদদের। নিজের হাতে ডায়েরিতে লিখে রাখেন শহীদদের নাম, শহীদ হওয়ার তারিখ এবং কোন যুদ্ধে শহীদ সে বিস্তারিত। 

ডলুরায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতীর বীর সন্তানেরা।

মো. মন্তাজ মিয়া, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, মো. রহমত বখত, মো. জবান আলী, মো. তাহের আলী, মো. আব্দুল হক, মো. মুজিবুর রহমান, মো. নূরুল ইসলাম, মো. আব্দুল করিম, মো. সুরুজ মিয়া, মো. ওয়াহিদ আলী, মো. সাজু মিয়া, মোহাম্মদ ধনু মিয়া, মো. ফজলুল হক, মো. সামছুল ইসলাম, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. মরম আলী, মো. আব্দুর রহমান, মো. কেন্তু মিয়া, মো. মোস্তফা মিয়া, মো. সাত্তার মিয়া, মো. আজমান আলী, মো. সিরাজ মিয়া, মো. সমছু মিয়া, মো. তারা মিয়া, মো. আবেদ আলী, মো. আতর আলী, মো. লাল মিয়া, মো. চান্দু মিয়া, মো. সমুজ আলী, মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. দান মিয়া, মো. মন্নাফ মিয়া, মো. রহিম মিয়া, মো. আলী আহমদ, মো. ছিদ্দিক মিয়া, এমবি ছিদ্দিক, মো. সাইদুর রহমান, মো. রহমত আলী, মো. আব্দুল হামিদ খান, মো. আব্দুল ছিদ্দিক, মো. আব্দুল খালেক, যোগেন্দু দাস, শ্রীকান্ত বাবু, হরলাল দাস, অধর দাস, অরবিন্দু রায় এবং কোবিন্দ্র নাথ– শহীদদের এই নামের তালিকা মধু মিয়ার খাতা থেকে জানতে পারেন সবাই।

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে ১৯৭৯ সালে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট শহীদদের সমাধিগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়। ৮২ ফুট লম্বা, ৮১ ফুট প্রস্থ ও পাঁচ ফুট উচ্চতার এক দেয়াল তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর সেনানী সাব সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) এএস হেলালউদ্দিন সব শহীদদের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে দেন।

ডলুরা সমাধিসৌধের স্মৃতিফলক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীনে বালাট সাব সেক্টরের আওতায় ছিল এই ডলুরা এলাকা। ডলুরার পার্শ্ববর্তী সীমান্তের ‌ওপারের মৈলাম এলাকায় কয়েক লাখ বাঙালি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। এপারের জয়বাংলা বাজার ছিল মুক্ত এলাকা। পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে আসতে পারত না। 

জয়বাংলা বাজারের কয়েক কিলোমিটার দূরে সুরমা নদী, দক্ষিণ পাড়ে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। আর বালাটের একটি পাহাড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকায় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে শহীদ ৪৮ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয় এই ডলুরায়। 

স্থানীয়রা জানান, শহীদদের কবর দেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন মধু মিয়া। এ কাজে সহযোগিতা করতেন এ ছাড়া আফছার উদ্দিন, কিতাব আলী, আব্দুর রহিম, মোগল মিয়া, হযরত আলী ও মফিজ উদ্দিন। মুসলিম শহীদদের জানাজা পড়াতেন মুন্সি তারু মিয়া আর হিন্দু শহীদদের দাফন করতেন নেপু ঠাকুর। 

২০০৪ সালের ১৫ মার্চ মধু মিয়ার মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ডলুরা শহীদ স্মৃতিসৌধের ভেতরেই তাকে দাফন করা হয়। ৪৮ জন শহীদের সঙ্গে তিনিও সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।