একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারীদের সংখ্যাটা সরকারি হিসাব মতে ২ লাখ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সংখ্যাটা ৬ থেকে ১০ লাখের মতো। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ৪১ জন বীরাঙ্গনা পান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। চলতি বছরের ২৪ মে পর্যন্ত গেজেটভুক্ত ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার’ সংখ্যা মাত্র ৪৪৮ জন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে, তাতে গেজেটভুক্তির ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত একটি গুণগত গবেষণা পরিচালনা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। এ সময়ে অন্তত ১০ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারি ওয়েবসাইট, গেজেট, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এটি করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ সংঘটিত করেছেন এবং প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের একটা বড় অংশ যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেওয়া হয়। পরের বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের সম্মানিত করার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য নেওয়া হয় নানা কর্মসূচি, তার মধ্যে পুনর্বাসন বিষয়ক সব কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর।
২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিতে উচ্চ আদালতে পিটিশন দায়ের করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সংসদে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস হয়। তাতে ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা)’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা, মাসিক ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সব সুবিধা দেওয়া এবং আর্কাইভ তৈরির কথা বলা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের প্রথম প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তার পর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত (২০২২ সালের ২৪ মে) গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৪৪৮ জন।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিকে গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনার সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম। অন্যদিকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি ও সুবিধা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় সরকারের ও বিভিন্ন অংশীজনের ভূমিকা, প্রত্যয়ন ও আবেদনের প্রক্রিয়া, যাচাই-বাছাই ও গেজেট ঘোষণা এবং ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা জটিলতা বা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য এসেছে। এ ছাড়া সুশাসনের ৬টি নির্দেশকের আলোকে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সরকারি কার্যক্রম; রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ; পরিকল্পনা ও উদ্যোগ, হালনাগাদ ও নির্ভুল তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে সংবেদনশীলতার ঘাটতি এবং গেজেটভুক্তির প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে পর্যালোচনায়।
বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। সেগুলো হলো, বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করার সুনির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করা, উপজেলা পর্যায়ে গেজেটভুক্তির আবেদন প্রক্রিয়াসহ সুযোগ-সুবিধার তদারকি করতে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া, আবেদন নিষ্পন্ন করার সময়সীমার বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা এবং সে অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা।
সার্বিক তথ্য-প্রমাণ যাচাইয়ে আবেদনের সত্যতা পেলে বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার বাদ দেওয়া, গেজেটে তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করা এবং তথ্যগত জটিলতা এড়াতে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংক্রান্ত ভুল সংশোধনে দ্রুত ও বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া, বীরাঙ্গনাদের আবাসন সুবিধার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির বিষয়টি বাতিল করা এবং অস্বচ্ছল ও ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ দেওয়া।
এ ছাড়া বীরাঙ্গনাদের সম্মানজনক অবস্থানে নিতে তাদের অবদানকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং গণমাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের অবদান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকেন্দ্রিক সরকারি অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনাদের সম্পৃক্ত করা, বীরাঙ্গনাদের সামাজিক স্বীকৃতির জন্য সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া এবং বীরাঙ্গনাদের তালিকাভুক্তি থেকে সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কার্যকর জবাবদিহি কাঠামো তৈরি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বিশেষভাবে নজরদারি করা।