শুনে পিলে চমকানোর মতো ঘটনা। ১৫ বছরে তারা নিঃস্ব করেছেন অন্তত ৩০০ প্রবাসীকে। বিমানবন্দরে টার্গেট করে আলাপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব। তারপর সুযোগ বুঝে খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান। এরপরই ভুক্তভোগীর সমস্ত মালামাল লুট করে চম্পট।
শনিবার (১ অক্টোবর) দিবাগত রাতে ঢাকার বিমানবন্দর ও কদমতলী এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ভয়ঙ্কর এই চক্রটির চারজনকে ধরেছে র্যাব।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- আমির হোসেন, লিটন মিয়া মিল্টন, আবু বক্কর সিদ্দিক পারভেজ এবং জাকির হোসেন। তাদের কাছ থেকে মোবাইলফোন, অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত চেতনানাশক, যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণে ব্যবহৃত লাগেজ ও চোরাই স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে রোববার (২ অক্টোবর) দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য সাংবাদিকদের জানান এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব বলছে, চক্রটির মূল হোতা আমির হোসেন বিমানবন্দর এলাকার একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করেন। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করা আমির বিদেশফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধরে গত ১৫ বছর ধরে অজ্ঞান পার্টির এই চক্রটি পরিচালনা করে আসছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চলতি বছরেই আমির হোসেন র্যাবের হাতে দুইবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। তবে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই অপকর্মে জড়ান। ১৫ বছরে আমির প্রায় তিনশ বিদেশফেরত প্রবাসীকে অজ্ঞান করে তাদের নিকট হতে মূল্যবান মালামাল ও সম্পদ লুট করেছে চক্রটি। আমির হোসেনের বিরুদ্ধে শুধু অজ্ঞান ও মলম পার্টি সংক্রান্ত ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে।
র্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টি চক্রের তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ব্যাংকপাড়ায় সাধারণ যাত্রীদের, ব্যাংকে আগত গ্রাহকদের টার্গেট করে থাকে।
জানা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর কুয়েতপ্রবাসী এক ব্যক্তি হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এসময় এয়ারপোর্টে ওঁৎ পেতে থাকা অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে টার্গেট করে ও ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে অজ্ঞান করে তার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।
এঘটনায় ভুক্তভোগী প্রবাসী বাদী হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে এবং হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট হতে তথ্য সংগ্রহ করে গত রাতে র্যাব-১ এর একটি দল তাদের গ্রেপ্তার করে।
কমান্ডার মঈন বলেন, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের টার্গেট করার লক্ষ্যে বিমানবন্দরের টার্মিনালে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাস ফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করে। এটি মূলত তাদের একটি কৌশল।
কারা ছিল টার্গেট আর যেভাবে লুট :
প্রবাস থেকে থেকে ফেরার পর স্বজন আসেনি এমন যাত্রীদের টার্গেট করত চক্রটি। কৌশলে বিদেশফেরত ব্যক্তির সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চক্রের অন্য সদস্যদের তাদের নিকটাত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতো। পরে একই এলাকার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে রাজি করায়।
চক্রের সদস্যরেই বাসের টিকেট কেটে যাত্রা শুরু করতো। গাড়ি বা বাসে ভ্রমণের সময় চক্রের সদস্যগণ টার্গেট করা ব্যক্তিকে কৌশলে চেতনানাশক রাসায়নিক মিশ্রিত বিস্কুট খাইয়ে অচেতন করতো। পরে অজ্ঞান হওয়ার প্রবাসীর পকেট থেকে লাগেজের টোকেন নিয়ে বাস থেকে প্রবাসীর মালামাল নিয়ে চক্রটি পরবর্তী স্টেশনে নেমে পড়ত।
সম্প্রতি এক ভুক্তভোগীর মামলা, তারপর চক্রের সন্ধান:
গত ২ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা কুয়েতফেরত এক ব্যক্তি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছায়। ওই প্রবাসীকে শুরু থেকেই চক্রের একজন সদস্য অনুসরণ করে বাইরে আসেন। বগুড়া যাবার উদ্দেশ্যে প্রাইভেটকারে উঠে আজমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছায় এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারে টিকেট কাটতে গেলে কাউন্টারে পূর্ব থেকে প্রবাসী যাত্রীর ছদ্মবেশ অবস্থান নেন চক্রের মূলহোতা আমির হোসেন।
র্যাব মুখপাত্র জানান, চক্রের মূলহোতা ওই প্রবাসীকে বলেন, তার কাছে বাসের একটি অতিরিক্ত টিকেট আছে। পূর্ব থেকে সাজিয়ে রাখা একটি লাগেজ ও কিছু কুয়েতি দিনার দেখিয়ে আশ্বস্ত করেন সেও একজন প্রবাসী।
আমির হোসেনের কাছ থেকে সরল বিশ্বাসে টিকেট ক্রয় করে পাশের সিটে বসে বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ওই প্রবাসী। কিছুক্ষণ পর তাকে চক্রের মূলহোতা আমির হোসেন চেতনানাশক ওষুধ মেশানো বিস্কুট খেতে দেয়। এরপর প্রবাসী অজ্ঞান হয়ে গেলে চক্রটি তার সকল মালামাল লুট করে নিয়ে পথিমধ্যে সিরাজগঞ্জে নেমে যায়। পরে বাসের সুপারভাইজার বুঝতে পেরে ভিকটিমকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে ও পরিবারকে খবর দেয়।
আগে গ্রেপ্তার হয়েও কেন বারবার অপকর্মে?
চক্রটির মূলহোতা আমির হোসেন আগেও দুইবার ধরা পড়েছেন। তবে জেল থেকে ফিরে ফের জড়িয়েছেন অপকর্মে। বিমানবন্দরকেন্দ্রীক বাহিনীগুলো তার ব্যাপারে কি ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছিল প্রশ্ন ছিল কমান্ডার মঈনের কাছে।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, চক্রের মূল হোতা আমির হোসেনকে চলতি বছরে র্যাব দুইবার গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের হাতেও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি ১৫ মামলার আসামি। যতবারই ধরা পড়েছেন ততবারই জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। লুন্ঠন করা অর্থের একটা অংশ তিনি জামিন সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ায় লগ্নি করেছেন।