বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা ও বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে অভিমত ও সাংবিধানিক অধিকার বলে আদালতে দেওয়া একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পুরো প্রতিবেদন জুড়ে সাম্প্রদায়িক বার্তা ও রাষ্ট্রের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে বলেও মনে করেছেন সমালোচকরা। এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলার বাদী নারাজি দিয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী হেফাজতের আন্দোলন, হামলা, ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে ২০২০ সালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়– হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক, চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফয়জুল করিম ও হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীকে।
মামলায় আমিনুল ইসলাম বুলবুল অভিযোগ করেন, ‘এই তিন ব্যক্তি তাদের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন। যা রাষ্ট্রোদ্রোহিতার অপরাধের শামিল।’
আদালতে করা ওই মামলায় তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর মামুনুল হক তোপখানা রোডে বসে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যে বলেন, “যারা ভাস্কর্যের নামে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন করে, তারা বঙ্গবন্ধুর সুসন্তান হতে পারে না, এই মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে।”এসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়েছেন তিনি। তিনি রাষ্ট্র ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বিধায় এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের শামিল।’
একই মামলায় চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেন, ‘২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর যাত্রাবাড়ির গেণ্ডারিয়া এলাকায় এক সমাবেশে ফয়জুল করিম সেখানে আসা মানুষদের হাত উঁচিয়ে শপথ পড়ান। তিনি শপথে বলেন, “আন্দোলন করবো, জেহাদ করবো, রক্ত দিতে চাই না, দেওয়া শুরু করলে বন্ধ করবো না। রাশিয়ার লেলিনের ৭২ ফুট মূর্তি যদি ক্রেন দিয়ে তুলে সাগরে নিক্ষেপ করতে পারে, তাহলে আমি মনে করি শেখ সাহের মূর্তি আজকে হোক কালকে হোক তুলে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে।” এই শপথ বাক্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির পিতাকে অবজ্ঞা করে সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বৈধ সরকারের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা সৃষ্টি করেছেন। শৈল্পিক ও তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতি সংরক্ষণে বাধা প্রদান করতে উদ্যত হয়ে ভাস্কর্য ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে মামলায় অভিযোগ করা হয়, ‘২০২০ সালেল ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারির এক সমাবেশে বাবুনগরী বলেন, “মদিনা সনদে যদি দেশ চলে তাহলে কোনও ভাস্কর্য থাকতে পারে না।” তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, “ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবেন এবং ওই ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলবেন।’
এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল পিবিআই। পুলিশের এই তদন্ত সংস্থা মামলাটি তদন্ত শেষ করে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. তৈয়বুর রহমান মামলাটির আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাখিল করেন।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তিন জনকেই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ মেলেনি বলেও মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের পর কিছু মূল্যায়ন দিয়েছেন। তিনি চার্জশিটে উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদ ও মন্তব্য সাংবিধানিক অধিকার।’
তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিষদ বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘শতকরা ৯০ শতাংশ মুসলমানদের এই বাংলাদেশে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক শক্ত অবস্থান। তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ওয়াজ-নসিহত করে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচিত হয়েছেন। ভাস্কার্য স্থাপন প্রসঙ্গে তিন বিবাদীর (মামুনুল হক, সৈয়দ ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরী) দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই কোনও একটা ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ধর্মপ্রাণ এই মুসলিমপ্রধান দেশে তাদের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।’
তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেনি। তাদের বক্তব্যে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসমর্থনমূলক অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। আর এই অভিমতের বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মুসলিমপ্রধান দেশের জনমনে কুরআন-হাদিসের আলোকে তারা উপস্থাপন করেছেন। একটি স্বাধীন দেশে সরকারি কোনও কাজ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে তা যদি জনবিরোধী, ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, জাতি ও ধর্মবিরোধী হয়, তবে সেসব কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রত্যেক নাগরিক মত প্রকাশ করতে পারেন। এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কাজেই ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে ভাস্কর্য স্থাপন বিষয়ে তাদের এমন কার্য রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের আওতাধীন নয়। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নেতা ছিলেন। তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হলে, ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর আত্মা বা রুহকে এই ভাস্কর্যের জন্য মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুসলিম বিশ্বের কাছে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে তারাসহ দেশের বিশিষ্ট ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন আলেমরা ধর্মের প্রশ্নে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাজেই তাদের এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে বিবেচ্য নয়।’
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘মামুনুল হক, ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরী ব্যক্তি ও দলীয় কোনও কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে সরকারকে অমান্য করা কিংবা নিজেদের গড়া কোনও মতকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দেশের জনগণকে সরকার এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলে, রাষ্ট্রের মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্যে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের আওতায় আসে। কিন্তু মামলার ঘটনায় তাদের তিন জনের দেওয়া বক্তব্য, কর্মকাণ্ডে এমন কোনও বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে আনা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতির করা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি, এজন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।’
বিষয়টি বাদী আমিনুল ইসলাম বুলবুলকেও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বুলবুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে পিবিআইয়ে চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিয়েছি।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে লেখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার একক সিদ্ধান্তে এখানে কোনও কিছু হয়নি।’ ফাইনাল রিপোর্টকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এমন বক্তব্য লেখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, এমন চার্জশিটের সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কোনও ফাইনাল রিপোর্টে এরকম সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা এবং রাষ্ট্রের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার সমালোচনা করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে ও কলামিস্ট শাওন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘হেফাজত নামক এই সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে। পুলিশ হয়তো সেটাই অনুসরণ করেছে। হেফাজত নেতাদের এমন বক্তব্য কখনও সাংবিধানিক অধিকার হতে পারে না। এটা পিবিআই তাদের প্রতিবেদনেও বলতে পারে না। আমাদের সংবিধানের মূলনীতিই হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু এই ৫০ বছর পরও আমাদের এটা দেখতে হচ্ছে। এজন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দেয়নি।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. তৈয়বুর রহমান বলেন, ‘আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, সেই অনুযায়ী আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছি। এখন আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, এ বিষয়ে কী হবে। আমাদের তদন্তে বাদীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ বিষয়ে পিবিআই বোর্ড গঠন করেছিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ প্রমাণ করতে যে তিনটি (ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতা) বিষয় থাকা প্রয়োজন, তা এই মামলায় পাওয়া যায়নি।’
মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগ। এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মামলাটি গত এপ্রিলে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। আমরা এখনও তদন্ত করছি। তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে আদালতকে জানানো হবে।’