মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসন। চা শ্রমিকদের কল্যাণে এটি বরাবরই আওয়ামী লীগের আসন হিসাবে পরিচিত।
তবে ’৯০-এর পর থেকে এ আসনের মাধবপুর উপজেলায় এক পরিবারের প্রভাবে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে বিএনপি।
এখানে সাংগঠনিকভাবেও একাট্টা দলটি। যার প্রতিফলন ঘটে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে। বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও পাঁচজন ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপিদলীয়।
জাতীয় নির্বাচনেও এটি বহাল থাকবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। অন্যদিকে এই আসনে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হলেও ত্যাগী নেতাকর্মীরা উপেক্ষিত বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে দলের ভেতরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
জানা যায়, এখানে ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এমপি নির্বাচিত হন সায়হাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় পার্টি নেতা সৈয়দ মো. কায়সার। তিনি ১৯৮৮ সালে কৃষি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। অপরদিকে তার ভাই সায়হাম গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মো. ফয়সলের হাত ধরে একই আসনে শক্ত অবস্থান গড়ে বিএনপি। তিনি বিএনপিকে সংগঠিত করেন। আরেক ভাই বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান এসএফএএম শাহজাহান দীর্ঘদিন উপজেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি অংশ নেননি। এ আসনে বাকি সব সময়ই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ৬ বার এমপি নির্বাচিত হন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন বর্তমান বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুব আলী। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাওলানা আসাদ আলীও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ফয়সল ও শাহজাহানের বিএনপিতে একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। তাদের প্রভাবেই নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে ভূমিকা রাখছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী বিএনপি নেতা মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি জেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রায় সব মামলাই হাইকোর্টে মোকাবিলা করেন। সব মিলিয়ে বিএনপি এখানে একতাবদ্ধ।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯ হাজার ৭৬৩ জন। এর মধ্যে মাধবপুরে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৫ এবং চুনারুঘাটে ২ লাখ ২২ হাজার ৫০৮ জন। মাধবপুরের ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি বিএনপি, ২টি আওয়ামী লীগ, ৩টি আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী এবং ১টিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রও বিএনপি দলীয়। অন্যদিকে চুনারুঘাটের ১০টি ইউনিয়নের ৪টিতে আওয়ামী লীগ, ৩টিতে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী, ২টিতে বিএনপি ও ১টিতে জামায়াত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ দলীয়। মাধবপুরে চা বাগান আছে ৫টি এবং চুনারুঘাটে ছোট বড় মিলিয়ে ১৭টি। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই চা বাগানের ভোটাররা আওয়ামী লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগের আশা এবার চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ফলে আরও বেশি ভোট আসবে নৌকায়।
মাধবপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান হামদু বলেন, এটি সত্য যে, সায়হাম পরিবারই মাধবপুরে বিএনপির ধারক-বাহক। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে তারা যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। শুধু মাধবপুরে নয়, চুনারুঘাটেও তারা সমন্বয় করেন। তাদের কাছে নেতাকর্মীরা মূল্যায়ন পায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইনশাআল্লাহ্ ফল আমাদের পক্ষে আসবে। তিনি বলেন, আগে বাগানে আওয়ামী লীগের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তা এখন আর নেই। এখন বাগানে শিক্ষার হার বেড়েছে। তারাও ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে। ধোঁকা দিয়ে আর তাদের ভোট নেওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও আছেন যাদের বিবেক আছে। তারও নৌকায় ভোট দিবেন না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান বলেন, এটি বরাবরই নৌকার আসন। তবে বর্তমানে দলের অবস্থা কিছুটা নাজুক। এখানে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন নেই। এমনকি আমি নিজেই মূল্যায়ন পাই না। এ নিয়ে প্রকাশ্যে গ্রুপিং না থাকলেও, ভেতরে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। এখানে উন্নয়নও তেমন হয়নি। কোনো একটি রাস্তাও হয়নি। তবে এখানকার শীর্ষ নেতারা নেতাকর্মীদের নিয়ে বসলেই এসব ক্ষোভ শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, যেহেতু এ আসনটি বাগান এলাকা। তাই নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে নামলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যাকেই নৌকা দেয়া হোক, তিনিই পাশ করবেন।
চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী বলেন, দলের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। এখন আর নেই। সবাই ঐক্যবদ্ধ। অতীতের চেয়ে এখন অনেক ভালো। আগে বাগানগুলোর শ্রমিকদের দলের কোনো কমিটিতে রাখা হতো না। এবার আমরা কমিটিতে রেখেছি। তাই এবার আরও বেশি উৎফুল্লু হয়ে তারা কাজ করবেন। এখানে এবারও নৌকা জয়ী হবে।
সূত্র : যুগান্তর