স্বামীর ‘সুপার পাওয়ারে’ ক্লাসে না এসেই বেতন নেন শিক্ষিকা!

স্বামী মাদ্রাসার সুপার। স্ত্রী একই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা। মাদ্রাসা সুপার স্বামীর বদৌলতে ক্লাস না করেই সপ্তাহে দুয়েকবার মাদ্রাসায় এসে হাজিরা খাতায় কেবল স্বাক্ষর দিয়ে মাসের পর মাস বেতন-ভাতা তোলেন এই শিক্ষিকা। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার হাজী আক্রম আলী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা নার্গিস মনির।

মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হলেও সরকারি নিয়ম-নীতির বাইরে এখানে চলে মাদ্রাসা সুপার রফিকুল ইসলামের রাজত্ব। এখানে তাঁর কথাতেই তৈরি হয় নতুন আইন, নতুন নিয়ম। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক অভিযোগ রয়েছে মাদ্রাসা সুপার রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। জালিয়াতি ও দায়িত্বে অবহেলাসহ কয়েকটি অভিযোগে গত দুইমাস ধরে বন্ধ রয়েছে সুপারের বেতন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানা যায়। এতসবের মধ্যেও মাদ্রাসা সুপার রফিকুল ইসলামের অনিয়মের দৌরাত্ম্য থামছে না। সুপার ও সহকারী শিক্ষিকা স্ত্রীর স্বেচ্ছারিতায় এমপিওভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে হাজী আক্রম আলী দাখিল মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হয়। তৎকালীন সময়ে অন্যান্য শিক্ষকের সাথে স্ত্রী নার্গিস মনিরকেও সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করান মাদ্রাসা সুপার। অভিযোগ রয়েছে, নার্গিস মনিরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য নথিপত্রে অনিয়ম করে স্ত্রীকে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার। সহকারী শিক্ষিকা নার্গিস মনিরের নামে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। সুপার স্বামীর প্রভাব দেখিয়ে দায়িত্বপালনে গাফিলতি ও বিনাশ্রমে বেতন-ভাতা ভোগ করে আসছেন তিনি।

উল্লেখিত অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে অনুসন্ধান করলে জানা যায়, নার্গিস মনির মাদ্রাসায় ক্লাস না করেই কেবল স্বাক্ষর দিয়ে সরকারি বেতন-ভাতাসহ মাদ্রাসার সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। সপ্তাহে দুয়েকদিন কিছু সময়ের জন্য মাদ্রাসায় আসেন তিনি। তবে ক্লাস করাতে নয়, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিতে। অনুপস্থিত দিনের স্বাক্ষর দিয়ে কোনো ধরণের ছুটির আবেদন ছাড়াই বাড়িতে চলে যান তিনি।

এমন তথ্যের সত্যতা যাছাই করতে সপ্তাহখানেক সময় মাদ্রাসাকে গোপন পর্যবেক্ষণে রাখেন এই প্রতিবেদক। চলতি সপ্তাহের শনি, রবি এবং সোমবার মাদ্রাসায় আসেননি তিনি। হাজিরা খাতায় সকল শিক্ষক স্বাক্ষর দিলেও নার্গিস মনির মাদ্রাসায় না আসাতে স্বাক্ষর দিতে পারেননি। এই প্রতিবেদকের কাছে হাজিরা খাতায় তার অনুপস্থিতির ছবি প্রয়োজনীয় নথি হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।

এদিকে, গত সোমবার দুপুরে ১০ মিনিটের জন্য বিদ্যালয়ে এসে অনুপস্থিত সকল দিনের স্বাক্ষর দিয়ে কোনো ধরণের ছুটির আবেদন ছাড়াই বাসায় চলে যান তিনি। সহকারী শিক্ষিকা নার্গিস মনিরের এমন কার্যকলাপ নিত্যদিনের বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, নার্গিস ম্যাডাম তো কোনো ক্লাস করান না। তিনি কেবল মাদ্রাসায় আসেন স্বাক্ষর দিতে। স্বাক্ষর দিয়ে আবার চলে যান। তার স্বামী মাদ্রাসার সুপার, তাই ছুটি নিতে হয় না, জবাবদিহি করতে হয় না।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শিক্ষিকা নার্গিস মনিরের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

শিক্ষিকা মাদ্রাসায় না এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাদ্রাসার সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি (শিক্ষিকা) আজ এসেছিলেন, দুপুরে চলে গেছেন। তিনি একটু অসুস্থ, তাই মাঝে-মধ্যে ক্লাসে আসতে পারেন না। অনুপস্থিত থেকে স্বাক্ষর দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।

এ সময় হাজিরা খাতায় লাল কালি দিয়ে নার্গিস আক্তারের স্বাক্ষর মেটানোর চেষ্টা করেন সুপার।

দিনের পর দিন মাদ্রাসায় অনুপস্থিত থাকলেও কেন কোনো ছুটির আবেদনের প্রয়োজন হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নিয়ম সবার জন্য সমান। অনুপস্থিত থাকলে অবশ্যই ছুটির আবেদন করতে হবে। আমার স্ত্রী বলে কথা নয়।

এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, একজন শিক্ষক ক্লাস না করে অনুপস্থিত থেকে কেবল স্বাক্ষর দিয়ে বেতন-ভাতা তুলবেন এটি বিবেকহীনতা। আমি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখব। সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।