আয়-রোজগার বা হাতে টাকা-পয়সা না থাকলেও অনেকের মাদক নেওয়া বন্ধ থাকে না। মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে অনেকে জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। একই কারণে ঘটছে চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে হত্যার মতো ঘটনাও। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে মাদকের ভয়াবহতা অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেকের ধারণা, যাদের আয় বেশি, টাকা বেশি, তাদের আয়েশি জীবন। তারা ইচ্ছা করলেই যেকোনও সময় মাদক সেবন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি উল্টো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যাদের কোনও আয় নেই, মাদকে জড়িয়ে পড়াদের মধ্যে তাদের সংখ্যা বেশি।
সম্প্রতি প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে আয় নেই এমন মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৩.৬৪ শতাংশ। এছাড়া যাদের মাসিক আয় পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। ২০২০ সালে দেখা গেছে, পাঁচ হাজার বা এক থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করা মানুষের মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা ১৬.৬৭ শতাংশ। যা ২০১৯ সালে ছিল ২২.৮২ শতাংশ।
২০২১ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে— নিম্ন শ্রেণি, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে মাদকের প্রবণতা বেশি। আয় নেই এমন মাদকসেবীর সংখ্যা ৬৩.৬৪ শতাংশ। ১০ হাজার বা এক থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করা মানুষের মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা ১১.১৬ শতাংশ। পাঁচ হাজার বা এক থেকে ১০ হাজার টাকা আয়কারীর মধ্যে এ সংখ্যা ৯.০৯ শতাংশ। যানবাহন চালকদের মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ৭.০৮ শতাংশ। শ্রমজীবী বা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের মধ্যে শতকরা হার ৭.০৮। চাকরিজীবীদের মধ্যে এ প্রবণতা ৬.১২ শতাংশ। আর যারা ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ১০.১১ শতাংশ।
২০২০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আয় নেই এই ধরনের মাদকসেবীর সংখ্যা ৫৭.৮৭ শতাংশ। ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করা মানুষের মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা ১৫.১৫ শতাংশ। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয়কারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১৩.৬৫ শতাংশ। যানবাহন চালকদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ৫.০৮ শতাংশ। শ্রমজীবী, মজদুর বা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের মাদকে জড়িয়ে পড়ার হার শতকরা ৫.০৮। চাকরিজীবীদের মধ্যে মাদকের জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ৮.১২ শতাংশ। ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের মধ্যে মাদকের জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা গেছে ৭.১১ ভাগ।
কোন বয়সে কত আয়, কী পেশা– এসব বিষয় বিবেচনায় মাদক গ্রহণে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হেরোইন ও ইয়াবা। মাদক গ্রহণের তালিকায় হেরোইনসেবীর সংখ্যাই বেশি। পরের ধাপে রয়েছে ইয়াবা।
২০২১ সালে হেরোইন আসক্তদের সংখ্যা ৩৪.৫৪ শতাংশ। ইয়াবাসেবীর সংখ্যা ৩০.১৮, গাজায় আসক্তির সংখ্যা ২৫.০৯ শতাংশ। ২০২০ সালে দেখা গেছে, ৩৪.০১ ভাগ হেরোইনে আসক্ত। ২৭.৯২ শতাংশ ইয়াবায় আসক্ত। গাজায় আসক্ত ১৯.২৯ শতাংশ। অ্যালকোহল সেবীর সংখ্যা ১.০২, ফেনসিডিল ৩.০৫, গ্লু ০.৫২ ও ইনজেকশন ড্রাগ ৩.৫৬ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধের পেছনে মাদক একটি বড় বিষয় হিসেবে কাজ করে। মাদকাসক্তের কারণেই অনেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। খুনের মামলা কিংবা চুরির-ডাকাতির মামলার আসামি, ছিনতাই কিংবা নারী নির্যাতন মামলার আসামিদের মধ্যে কমন একটি বিষয় দেখা যায়। তা হলো তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। যে যেকোনও অপরাধে গ্রেফতার হোক না কেন, বিভিন্ন তথ্যে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তদন্ত করে আমরা যাদের গ্রেফতার করছি, তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। মাদক নেওয়ার পর শরীরে এক ধরনের হেলুসিনেশনের সৃষ্টি হয়। ফলে যেকোনও ধরনের অপরাধ সংগঠিত করতে তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও বোধ কাজ করে না। বিশেষ করে যারা প্রতিনিয়ত মাদক সেবন করে তাদের অনেকেই টাকা সংগ্রহের জন্য চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব চুরি-ছিনতাইয়ের কারণে ঘটছে হত্যার মতো ঘটনা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া মাদক থেকে দূরে থাকতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে।’
এত মাদক ধরার পরও মাদকের প্রবণতা কমছে না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘যেসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তা অনেকটাই লোক দেখানো। অভিযান পরিচালনা করে প্রধানত দুই ধরনের মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। যারা সেবনকারী আর যারা বহনকারী। মাদকের পেছনে মাস্টারমাইন্ড যারা, যারা মূল কারবারি তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি তেমন দেখা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘যারা গ্রেফতার হয় তারা মাদকসেবী কিংবা বহনকারী। পেছন থেকে অনেকেই তাদের জামিনের ব্যবস্থা করে। যার ফলে তারা জেল থেকে বেরিয়ে একই পেশায় জড়িয়ে পড়ে।’