সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলন্ত বাসে তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় চালকের পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় চারজনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা এবং আরেকটি ধর্ষণের মামলায় একজনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড, আরেক আসামির ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার রায় প্রদান করেছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন এই পৃথক তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আদালতের দায়িত্বশীলরা জানান, জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দীগেন্দ্র বর্মন ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। ২০১২ সালের ৩১ আগস্ট দুপুরে অফিসের কাজে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরে আসেন তিনি। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশে রওয়ানা দিলে আসামি আনোয়ার হোসেন তাকে জোর করে মোটরসাইকেলে তুলে তাহিরপুর সীমান্তের শাহ্ আরেফিন মোকামের পাশে নিয়ে যান। মোকামের পাশের আখক্ষেতে নিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। এসময় হঠাৎ করে পাশে থাকা আসামি শয়ফুল্লাহ, সাইদুর রহমান ও শফিকুল তাদেরকে ঘেরাও করেন। একপর্যায়ে আসামি আনোয়ার হোসেনকে বেঁধে ওই ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তারা। আসামি সেলিম, আনোয়ারুল আজিম আকাশ ও মাফিনুর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। পরে এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়। আসামি শফিকুল, শয়ফুল্লাহ ও ছাইদুর রহমান ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে। মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষ ৮ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করে। সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে আদালত আসামি আনোয়ার হোসেন খোকন, শয়ফুল্লাহ, ছাইদুর রহমান ও শফিকুলকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানার সাজা প্রদান করেন। জরিমানার টাকা ভিকটিম ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন। রায় ঘোষণার সময় আসামিগণ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, দুই বছর আগে দিরাইয়ে চলন্ত বাসে কলেজ শিক্ষার্থী তরুণীকে নির্যাতনের আলোচিত ঘটনার অপরাধীকেও বৃহস্পতিবার কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর দিরাই শহরের মজলিশপুর গ্রামের ওই শিক্ষার্থী সিলেটের লামাকাজী থেকে নিজ বাড়িতে আসার জন্য বাসে ওঠেন। গাড়িটি দিরাই সড়কের মাথায় এলে তিনি বাস থেকে নামার চেষ্টা করেন। এসময় চালক শহিদ মিয়া কৌশলে তাকে নামতে না দিয়ে বাস চালাতে থাকেন। ওই তরুণীকে পুনরায় দিরাই নিয়ে নামিয়ে দেবেন বলে জানান চালক। তখন বাসে আর কোনো যাত্রী ছিল না। বাসটি কাঠইর ব্রিজ পার হওয়ার পর চালক হেলপারকে গাড়ি চালাতে দিয়ে তরুণীর পাশের সিটে জোরপূর্বক বসে পড়েন এবং তার ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসেন। মেয়েটি তার ভ্যানিটি ব্যাগ আনার জন্য পেছনে গেলে চালক তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। মেয়েটি আত্মরক্ষায় জোর করে দরজার কাছে এসে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে যান। পরে অন্যরা এসে আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেন। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হলে আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে। শেষে রাষ্ট্রপক্ষ ৯ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করে। সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে আদালত বৃহস্পতিবার শহিদ মিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এই জরিমানার টাকা ভিকটিম পাবেন। রায় ঘোষণার সময় আসামিগণ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সুনামগঞ্জের ছাতকের আরেকটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় আসামি ইকবাল হোসেনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লক্ষ টাকা জরিমানা এবং আসামি জয়নাল আবেদীনকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দিয়েছেন একই আদালত। অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
জানা যায়, ছাতকের মোহনপুর গ্রামে ২০১২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় বাড়ি থেকে এক তরুণীকে অপহরণ করে সিলেটে নিয়ে যায় আসামি ইকবাল হোসেন ও আসামি জয়নাল আবেদীন। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয়। পরে নির্যাতিতা থানায় এসে মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় চারজন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করে। সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে আদালত আসামিদের এই সাজা প্রদান করেন।
রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে নারী ও শিশু আদালতের পিপি নান্টু রায় বলেন, তিনটি রায়েই রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট। নির্যাতিতা বাদীগণ ন্যায়বিচার পেয়েছেন।