সুনামগঞ্জের ‘দেখার হাওর’ এর নাম বিকৃতি, স্থানীয়দের ক্ষোভ

“হাওরের ২৩২৩ দাগে আমাদের চার ভাইয়ের নামে ৬৯ শতাংশ ফসলি জমি আছে। এছাড়াও দেখার হাওর মৌজায় আরো একাধিক দাগে আমাদের প্রায় ৪০ একর জমি রয়েছে। জমির সব কাগজে মৌজার নাম “দেখার হাওর”। দেখার হাওর পাড়ে আমাদের বাড়ি। পূর্ব পুরুষরা এ হাওরে ধান চাষ ও মৎস্য আহরণ করেছেন। ছোট বেলা থেকেই হাওরকে দেখার হাওর নামে চিনি। কিন্তু কিছুদিন আগে দেখলাম আহসানমারা সেতুর পূর্বাংশে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক একটি সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। সেখানে দেখার হাওরকে ‘ডেকার হাওর’ লেখা হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। হঠাৎ করে কি কারণে নামের এমন পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে উঠলো তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এই নাম পরিবর্তন করে এলাকাবাসীর আবেগের জায়গার কথা চিন্তা করে এবং দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে ‘ডেকার হাওর’কে দেখার হাওর লেখার জোর দাবি জানাচ্ছি।”

সুনামগঞ্জের বড় হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম দেখার হাওরের নাম পরিবর্তন বিষয়ে মনে চরম অসন্তোষ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের দেখার হাওর পাড়ের আস্তমা গ্রামের বাসিন্দা মো. নূর মিয়া।

তার বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে পশ্চিম পাগলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জগলুল হায়দার বলেন, দেখার হাওরে আমাদের কয়েক শত একর জমি রয়েছে৷ ছোট বেলা থেকেই হাওরে বিভিন্ন বিলে মাছ ধরি। কোনো দিনই ডেকার হাওর নাম শুনিনি। হাওরটির প্রকৃত নাম দেখার হাওর। আমাদের অসংখ্য জমির দলিলেও দেখার হাওর লেখা। নাম পরিবর্তন কাম্য নয়।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, সুনামগঞ্জ জেলার সদর উপজেলা, শান্তিগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজারের বিশাল জায়গা নিয়ে দেখার হাওর গঠিত। জেলার শস্য ভাণ্ডার খ্যাত এ হাওরে মোট জমির পরিমান ৪৫ হাজার ৮ শ ৬৯ হেক্টর। এর মধ্যে চাষাবাদ হয় ২৪ হাজার ২শ ১৪ হেক্টর জমিতে। চাষাবাদকৃত এসব জমিতে বছরে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৪শ মেট্রিকটন ধান উৎপন্ন হয়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেখার হাওরের উৎপাদিত ধানে সমস্ত দেশের প্রায় ১৫ দিনের খাদ্যের যোগান হয়।

এছাড়াও বর্ষায় কিংবা হেমন্তে এ হাওর-বিলে-ঝিলে মাছ ধরে কয়েক হাজার জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করেন। চার উপজেলাসহ সমস্ত জেলার অর্থনীতির পাশাপাশি হাওরটি জাতীয় অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি কৃষক-জেলের আবেগ ও অনুভূতির এক কেন্দ্রস্থল হচ্ছে দেখার হাওর। এ নামের সাথে মিশে আছে হাওর পাড়ের কৃষক-জেলের জীবনোপাখ্যান। বর্ষায় পাল তোলা নৌকা থেকে শীতের ঘাসের শিশিরবিন্দুসহ সব কিছুর সাথে মিশে আছে দেখার হাওর নামটি। হঠাৎ করে দেখার হাওর থেকে ‘ডেকার হাওর’ বনে যাওয়ায় অবাক হয়েছেন হাওর পাড়ের মানুষজন। প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। দাবি তুলেছেন নাম সংশোধনের।

বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) আহসানমারায় গিয়ে দেখা যায়, সাত লাইনের একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেখানের তিন স্থানে ভুল বানান লিখা হয়েছে। বোর্ডে বিশাল বড় বড় অক্ষরে দেখার হাওরকে লিখেছে ‘ডেকার হাওর’। সুনামগঞ্জ সদরকে লেখা হয়েছে সুনামগঞ্জ-সদব এবং আহসানমারার নাম পরিবর্তন করে লিখা হয়েছে আসনমারা। নাম পরিবর্তন ও ভুলে ভরা এমন সাইনবোর্ড দেখে ক্ষুব্ধ স্থানীয় এলাকাবাসী ও সুধীজন।

জয়কলস নোয়াগাঁও (খাইক্কারপাড়) গ্রামের আনোয়ার হোসেন, সুরুজ আলী, আয়নাল মিয়া ও উত্তর জয়কলসের রব্বানী মিয়া বলেন, আমাদের জন্ম দেখার হাওর পাড়ে। ছোট বেলা থেকেই শুনেছি, জেনেছি এই হাওরের নাম দেখার হাওর। দেখার হাওর মৌজায় আমাদের জমিও আছে। কাগজে কলমেও দেখার হাওর। তাহলে এটা ডেকার হাওর হয় কীভাবে? আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দ্রুত নাম ঠিক করা হোক। দেখার হাওর নামটিও সুন্দর।

শাহজালাল মহাবিদ্যালয়ের সহযোগি অধ্যাপক ও লেখক এনামুল কবির বলেন, আমাদের দেখার হাওর- দেখার মতো একটা হাওর এবং এটা এখন অপ্রচলিত কোনও নাম নয়। এই নামটাও বেশ শ্রুতি মধুর। তাহলে এটা পরিবর্তনের কী প্রয়োজন? থাকুক এটা।

লেখক ও গবেষক ইকবাল কাগজী চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি কিছু কর্মকর্তার ইংরেজি প্রীতির কারণেই নামের এমন বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলায় লেখার কথা থাকলেও তারা ইংরেজির অনুবাদ করতে গিয়েই দেখার হাওরকে ডেকার হাওর লিখেছেন। এটা মোটেও ঠিক নয়। দীর্ঘ দিনের একটি নামকে এভাবে পরিবর্তন দুঃখজনক। যত দ্রুত সম্ভব দেখার হাওরকে দেখার হাওরে ফিরিয়ে আনা হোক।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাওয়ের সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, নামের এমন বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে ২০১৭ সালে পিআইসি প্রথা চালুর পর থেকে। তখন তারা (পাউবোর কর্মকর্তারা) লিখতো ডেকার হাওর ডাইক-১, ডাইক-২…। এখন তারা হাওরের নাম সাইনবোর্ডের মাধ্যমে পরিবর্তনের পায়তারা শুরু করেছে। আমরা শুরু থেকে এর প্রতিবাদ করে আসছি৷ আমরা চাই দেখার হাওর নামটিই বহাল থাকুক। দ্রুত ডেকার হাওর থেকে দেখার হাওর করা হোক।

সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, দুইটি নামই সঠিক। এ নিয়ে জেলা কমিটির মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা যাচাই-বাছাই করছি। যাচাই-বাছাইয়ের পর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো কী করা যায়। বানান ভুলের বিষয় তিনি বলেন, বানান ভুল কাম্য নয়। আমরা দেখছি।