সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা থাকা অর্থের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, সেই দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এক বাংলাদেশি সম্পর্কে তথ্যও সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে ওই অর্থপাচারকারীর নাম প্রকাশ করেনি বিএফআইইউ। তবে নিশ্চিত করা হয়েছে, সরকারের একটি সংস্থার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছর আগে বিএফআইইউ থেকে সুইজারল্যান্ডের কাছে তথ্য চাওয়ার পর অনেকগুলো প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একজন অর্থপাচারকারীর তথ্য সরবরাহ করেছে দেশটি।
অবশ্য ওই ব্যক্তির পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা তা বলতে পারে না বিএফআইইউর কোনও কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকে তথ্য সরবরাহ করা ও চাহিদা অনুযায়ী তথ্য এনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আমাদের নয়, অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কাজ করে অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা। তারা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।‘
হঠাৎ কেন সুইস ব্যাংক প্রসঙ্গ
গত বুধবার (১০ আগস্ট) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড জানান, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধ পথে আয় করা হয়েছে, এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য চায়নি। তার এ বক্তব্য পরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দেয়।
রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পরদিন বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ রাখার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে কিনা, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
এদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট তথ্য চায়নি বলে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে দাবি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার পর নতুন করে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে সুইজারল্যান্ডের কাছে বিএফআইইউ কবে— কী তথ্য চেয়েছে তার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এই তালিকা আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
প্রতি বছর তথ্য চাওয়া হয়
সর্বশেষ সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশের পর চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে সুইজারল্যান্ডের কাছে তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ। তবে সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে কোনও জবাব আসেনি।
জানা গেছে, প্রতিবছর সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি প্যারাডাইস, পানামা, প্যান্ডোরা পেপারস বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থপাচারের বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
কেন সব তথ্য দেয় না সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা এফআইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের এফআইইউর আলাদা কোনও চুক্তি নেই। ২০১৪ সাল থেকে দেশটির সঙ্গে চুক্তির জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি। আর চুক্তি না থাকায় সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে অধিকাংশ সময় জবাব আসেনা।
সরাসরি দেশটির বিএফআইইউর সঙ্গে চুক্তি করা সম্ভব হলে বিশদ তথ্য পাওয়া সহজ হতো। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে এফআইইউ চুক্তি করলেও সুইজারল্যান্ডকে রাজি করাতে পারেনি বাংলাদেশ।
একসময় সুইজারল্যান্ড কোনও রকম তথ্য প্রকাশ করতো না। এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার ফলে প্রতিবছর সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের দায় ও সম্পদের তথ্য প্রকাশ করছে।
তবুও তথ্য আদান-প্রদান করে দুই দেশ
সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের এফআইইউর কোনও চুক্তি না থাকলেও দুটি সংস্থাই ‘এগমন্ট গ্রুপে’র সদস্য। এ কারণে একে অপরের সঙ্গে নিরাপদ ওয়েবপোর্টালের (এগমন্ড সিকিউর ওয়েব- ইএসডব্লিউ) মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করে। এগমন্ট সিকিউর ওয়েব হলো— বিভিন্ন দেশের এফআইইউর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম। ২০১৩ সালে এই ফোরামের সদস্য হয় বিএফআইইউ।
গত ১৮ জুন এক সেমিনারে বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসেন জানান, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের ৯৭ শতাংশই বিভিন্ন ব্যাংকের। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তির জন্য এটা রাখা হয়। বাকি ৩ শতাংশ ব্যক্তিগত আমানত। ফলে কেউ সন্দেহ করলে এই ৩ শতাংশ অর্থ নিয়ে করতে হবে। তবে এই অর্থ বাংলাদেশিদের হলেও পুরোটাই যে বাংলাদেশ থেকে গেছে, তেমন নয়।
বিএফআইইউ ছাড়াও তথ্য চাইতে পারে আরও যেসব প্রতিষ্ঠান
বিএফআইইউ ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তথা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যে কোনও তথ্য চাইতে পারে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্যবিনিময় করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব চ্যানেল ছাড়াও এমএলএর আওতায় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকেও বিভিন্ন দেশের কাছে তথ্য চাওয়া হয়।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জমা
সর্বশেষ গত ১৫ জুন ২০২১ সালের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি)। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে সেখানকার ব্যাংকে থাকা অর্থে বড় উল্লম্ফন হয়ে মোট ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাংক হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা (প্রতি ফ্রাংক ৯৬ দশমিক ২ টাকা দর ধরে)।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশিদের নামে সেখানে রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৩০ কোটি ৮১ লাখ ফ্রাংক (৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ); টাকার হিসাবে যা প্রায় ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের নামে থাকা গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আসে যেভাবে
পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। পাচারের সন্দেহভাজন তথ্য পাওয়ার পর প্রথমে এক দেশ থেকে আরেক দেশের প্রাথমিক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিজ দেশে মামলা করতে হয়। মামলা প্রমাণের পর মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের (এমএলএ) আওতায় তথ্য চাইতে হয়। এরপর সেই দেশের আইনে যদি অপরাধ হয়, তখন অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন