‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা’- দেশমাতৃকার তরে শহিদদের স্মরণে সংগীতের এই কথামালা অশ্রু ঝরায় স্বজনহারাদের।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর বধ্যভূমিতে বিস্মৃতির অতল গহীনে হারিয়ে যেতে বসা শহিদদের সমাধি মিললো অবশেষে। যে বদ্ধভূমিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ৭২ শহিদের স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করা হয়। তন্মধ্যে ৬৬ শহিদের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছে স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ ও উদ্যোক্তা কমিটি।
এতোগুলো বছর যাদের কোনো খোঁজ ছিলোনা, তাদের সমাধি খুঁজে বের করে দিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তান ডা. জিয়া উদ্দিন আহমদ ও তাঁর বন্ধু কর্নেল (অব.) আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক।
শনিবার (৪ মার্চ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। লাল ফিতা কেটে স্বামীসহ ৬৬ শহিদের স্মৃতিচিহ্ন উদ্বোধন করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্মৃতি উদ্যান সংরক্ষণ ও নির্মাণের উদ্যোক্তা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক তাকে শান্তনা দেন।
এরপর শহিদ পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচিহ্নে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কারো বাবা, কারো দাদা-দাদি, চাচাসহ স্বজনদের খুঁজতে এসেছেন সমাধিতে। স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে সিলেট ক্যাডেট কালেজের পেছনে অবস্থিত নতুন করে পরিচয় পাওয়া ‘পরিচয়হীন’ বধ্যভূমি।
সে সময় আবেগঘন বক্তব্য রাখেন, শহিদদের স্বজনরা। এই স্থানে এনে হত্যা করা হয় সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রাক্তণ অধ্যক্ষ লে. কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমান।
তার মেয়ে শাহরীন রহমান জানান, ২৬ মার্চ গৃহবন্দি হন। এরপর একাত্তরের ১৪ এপ্রিল তার বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাঁর ৫ বছর বয়স। বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদারেরা।
তিনি বলেন, ‘মায়ের কাছ থেকে জানলাম তিনি দেশকে খুব ভালোবাসতেন। ৯ এপ্রিল যখন শহিদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে হত্যা করা হলো, তখন তিনিই প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের চিকিৎসা দিতে বারণ করে দিয়েছিলেন। অবস্থা বুঝতে পেরে তার ছাত্ররা তাকে বর্ডার পাস করে দিতে চাইলেও তিনি যাননি। বলেছিলেন, আমি নিমকহারাম না। তখন আমরা ডক্টর্স কোয়ার্টারে ছিলাম। তাকে টার্গেট করার মূল কারণ, তখন তিনি বাংলাদেশের পতাকা বাড়িতে ও গাড়িতে ওড়াতেন।’
তিনি আরও বলেন, যখন তাকে অফিসের কাজের কথা বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন বাসার নিচে খেলছিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল বাবার কথা, দেখিয়ে দিয়েছিলাম দোতলায় আছেন। তখন যদি জানতাম আমার বাবাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে, তাহলে কি দেখিয়ে দিতাম? সেই স্মৃতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। ৫২ বছর পর আমি জানলাম কোথায় আমার বাবা ঘুমিয়ে আছেন। মা একটি কথা বলতেন- তোমার বাবা ফিরে আসবে। ৫২ বছর পর আমার বাবা ফিরে এসেছে। কিন্তু বাবা নয়, সমাধির মাধ্যমে বাবাকে খুঁজে পেলাম।
এই স্থানে শহিদ হন চা শ্রমিক ঘাটমা উড়াং। আজ তার নাতি গৌরাঙ্গ উড়াং ফুল হাতে এসে দাদার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তার মতো শহীদ গকুলন্দ চক্রবর্তীর মেয়ে রীনি চক্রবর্তী বাবার স্মৃতিচিহ্নে ফুল দিয়ে মাথা ঠোকরাতে শুরু করেন।
শহিদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল জানান, তার স্বামীর কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না। বধ্যভূমিতে স্বামীর স্মৃতিচিহ্নটুকু পরম পাওয়া। তাই স্মৃতিচিহ্ন দেখলেন, কাঁদলেন।
কাউন্সিলর তাকবীরুল ইসলাম পিন্টু জানান, স্বাধীনতার জন্য আমাদের শহিদ পরিবারের অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে আমার দাদা নামকরা ঠিকাদার ছিলেন। যে কারণে আমাদের ৯টি জিপ গাড়ি ছিল। আমার চাচা তজমুল আলী গাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতেন। সাধারণ মানুষকেও নিরাপদে পৌঁছে দিতেন। যেদিন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, রেললাইনের পাশে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ৩টি গুলি করে পাক হানাদাররা। দুটি গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হয়। তাকে রেললাইন দিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় টেনে নেওয়া হয়েছিল। ছেলে হারানোর আক্ষেপ নিয়ে ৯০ বছরে তার দাদি মারা গেছেন। কিন্তু ছেলের স্মৃতিচিহ্ন দেখে যেতে পারেননি।
নগরীর ছড়ারপার এলাকার বাছির মিয়া ও সুবিদবাজারের খাদেন্দ্র সিংহের সন্তানরা বাবার কবর খুঁজে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরকম পরিচয় পাওয়া ৬৬ শহীদের পরিবারের সদস্যরা একাত্তরে সিলেটে গণহত্যার বধ্যভূমিতে খুঁজে পেলেন তাদের প্রিয় মানুষটির স্মৃতিচিহ্ন।