সিলেটে শহিদমিনারের নকশা বহির্ভূত স্থাপনা অপসারণের দাবি

সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের মূল নকশা বহির্ভূত স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন সিলেটের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের ৫১ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

রোববার (২৩ অক্টোবর) সংবাদপত্রে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে নাগরিকেরা মূল নকশা ও অবকাঠামোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এই অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা ও নগরীর বিভিন্ন সড়ক দ্বীপে সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কহীন সকল স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে নাগরিকেরা সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের বর্তমান নকশা ও নির্মাণ ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্রের পরিকল্পিত হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনার। এ শহিদমিনার প্রতিষ্ঠায় সিলেটের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস সংগ্রাম। সেই শহিদমিনার পরিকল্পিত হামলায় ভেঙে দেওয়া হলে সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। নাগরিকদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে শহিদমিনার নতুন করে নির্মাণের দাবি ওঠে। এ অবস্থায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাংসদের উদ্যোগে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে শহিদমিনারটি পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর উদ্বোধন করেন। সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের মূল নকশাকার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক শুভজিত চৌধুরী। এছাড়া কৌশিক সাহা, সিপাউল বর চৌধুরী, ধীমান চন্দ্র বিশ্বাস ও জিষ্ণু কুমার দাস এটি নির্মাণে সহযোগী স্থপতি হিসেবে কাজ করেন। সিলেটি ঐতিহ্যকে মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই শহিদমিনার।

তারা বলেন, সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার আয়তন ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৮ শতাংশ জায়গার উপর স্থাপিত হয়েছে শহিদমিনারটি। এতে সমতল ভূমি থেকে ১০০ ফুট চওড়া আন্দোলিত ভূমি তৈরি করা হয়েছে। এই আন্দোলিত ভূমিকে শহিদমিনারের মুখ্য বিষয়বস্তু হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। উক্ত ভূমি থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভ। মাঝের স্তম্ভের উচ্চতা ৪৫ ফুট। আন্দোলিত ভূমির উপর ৪৫ ফুট উচ্চতার স্তম্ভটির মাধ্যমে আন্দোলিত ভূমি থেকে জেগে ওঠা বাঙালির আবহমান সংগ্রামী চেতনাকে নির্দেশ করে। স্তম্ভ তিনটির সম্মিলিত প্রস্ত ৩০ ফুট। স্তম্ভগুলো কংক্রিট দিয়ে তৈরি করে এর উপর শ্বেত পাথর বসানো হয়েছে। মাঝের স্তম্ভটিতে বসানো হয়েছে রক্তিম সূর্য। সূর্যোদয়ের মাধ্যমে নতুন দিনের কথা জানাতে সূর্যটি স্তম্ভটিতে স্থাপন করা হয়েছে। স্টিলের তৈরি লাল রঙের এই সূর্যের ব্যাস সাড়ে পাঁচ ফুট। মাঝের স্তম্ভের ডানে-বাঁয়ে যে দুটি স্তম্ভ রয়েছে, সেগুলোতে জানালার মতো চারটি অংশ রয়েছে। এসব জানালায় বাঙালির মুক্ত জীবনকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তারা আরও বলেন, উদ্বোধনের পর থেকেই সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনার সর্বমহলের প্রশংসিত হয়। যদিও ২০১৪ সালে শহিদমিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধসহ শহিদমিনার কম্পলেক্সের পূর্ণাঙ্গ কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। বিগত আট বছরেও শহিদমিনার কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ না হলেও গত এপ্রিল মাসে শহিদ স্মৃতিসৌধ ও শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের মধ্যবর্তি স্থানে (মূল নকশায় যা উন্মুক্ত প্রদর্শনীর জন্য সংরক্ষিত) স্মৃতিস্তম্ভের আদলে চারটি খাম্ভা দিয়ে মূল নকশা বহির্ভূত একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। যা নাগরিকদের দৃষ্টিগোচর হলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত লেখালেখি থেকে জানা যায়, মূল স্থপতিদের সাথে কোনোরূপ আলোচনা না করে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর খেয়ালখুশিতে এই স্মৃতিসৌধের আদলে একটি কবিতাপাঠের মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। তেত্রিশ শতাংশ জায়গাতে দুটি পৃথক মঞ্চ স্থাপনে শুধু শব্দদূষন নয়, ভবিষ্যতে শহিদমিনার প্রাঙ্গণে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এমতাবস্থায় আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিবর্গ সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে স্থাপন করা মূল নকশা বহির্ভূত স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত বলে মনে করি। একই সাথে ব্যক্তি-বিশেষের খেয়ালখুশিতে মূল নকশা পরিবর্তন ও নগরীর বিভিন্ন সড়ক দ্বীপে সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যহীন স্থাপনা নির্মাণের নিন্দা জানাই। আমরা আশা রাখি, সিলেট সিটি কর্পোরেশন ভবিষ্যতে জনগণের সম্পদ বিনষ্ট না করে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করবে। একই সাথে দৃষ্টিকটু সকল অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণ করে নগরের সৌন্দর্য্যপিপাসু নাগরিকদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাবে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশ আলী, মুক্তিযোদ্ধা কবি ও লেখক তুষার কর, শহিদমিনার বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য চিত্রশিল্পী হ্যারল্ড রশিদ চৌধুরী, লেখক-গবেষক শুভেন্দু ইমাম, স্থপতি সৈয়দা জেরিনা হোসেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ, সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের মূল নকশা প্রণেতা স্থপতি শুভজিৎ চৌধুরী, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড ধীরেন সিংহ, ওয়ার্কাস পার্টির সিলেট জেলা সভাপতি কমরেড সিকান্দার আলী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ই ইউ শহিদুল ইসলাম, নাগরিক কমিটি সিলেটের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরী, কবি এ কে শেরাম, সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম শফিকুর রহমান, ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন যাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পিপি অ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন, স্পেশাল পিপি শাহ মোশাহিদ আলী ও শাহ ফরিদ আহমেদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সহ-সভাপতি জামিল আহমেদ চৌধুরী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. নাজিয়া চৌধুরী, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় কৃষ্ণ বিশ্বাস, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিজিত চৌধুরী এবং তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক গোলাম সোবহান চৌধুরী (দিপন), সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম সিলেটের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সরওয়ার আহমদ চৌধুরী, বাংলার মূখ সিলেটের আহ্বায়ক ডা. নাজরা চৌধুরী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সিলেট জেলার সভাপতি এনায়েত হাসান মানিক, শহিদমিনার বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম সদস্য এনামুল মুনির, তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে (যাদু), বাসদ (মার্কসবাদী) সিলেট জেলার আহ্বায়ক উজ্জ্বল রায়, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক কমরেড আনোয়ার হোসেন সুমন, গণহত্যা বিষয়ক গবেষক হাসান মুর্শেদ, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম, ঐক্য ন্যাপ সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস বাবুল, নাগরিক মৈত্রী সিলেটের আহ্বায়ক সমর বিজয় সী শেখর, গণতন্ত্রী পার্টি সিলেট জেলার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গুলজার আহমদ, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মনির হেলাল, গীতিকার ও লেখক প্রিন্স সদরুজ্জামান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুদীপ্ত অর্জুন, প্রগতি লেখক সংঘের সহ-সভাপতি মাধব রায়, সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক মুকির হোসেন চৌধুরী, সংবাদকর্মী উজ্জ্বল মেহেদী, গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক দেবব্রত রায় দিপন ও জেলা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জান্নাত আরা খান পান্না, নাট্য সংগঠক হুমায়ুন কবির জুয়েল, গণসংগীত শিল্পী রতন দেব, দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’র সংগঠক অ্যাডভোকেট দেবব্রত চৌধুরী লিটন, নগরনাট’র সভাপতি উজ্জ্বল চক্রবর্তী, সেইভ দ্যা হেরিটেইজ অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট’র সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদি, আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন ও পরিবেশকর্মী মো. রেজাউল কিবরিয়া।