সিলেট বিভাগের ১৯টি সংসদীয় আসনে এবারের মতো রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগে এর আগে আর দেখা যায়নি। যেখানে এবার ১৯ আসনে আওয়ামী লীগের ১৭২ নেতা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তবে জমা হয়েছে ১৪৮টি। মনোনয়নপত্র ক্রয় করলেও জমা পড়েনি ২৪টি।
মনোনয়নপত্র বিক্রির হিসাব অনুযায়ী সিলেটের প্রতিটি আসনে গড়ে ৯ জন করে প্রার্থীর মনোনয়নের জন্য লড়াই করার কথা ছিল। তবে জমার পর গড় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ জনে।
এদিকে উদ্বেগের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর সময় কাটছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের। দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আজকালের মধ্যে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। সব মিলিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ সিলেট বিভাগের আওয়ামী পরিবারের সবার কৌতূহলী দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। তাছাড়া বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আসন ভাগাভাগি।
এদিকে সিলেট-৬ আসনের হেভিওয়েট প্রার্থী বর্তমান এমপি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এর আগে দলের প্রেসিডিয়াম থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়। এই আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রধান শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম প্রার্থী হচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। ফলে নাহিদের মনোনয়ন ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন আলোচনা সিলেটের সর্বত্র। শুধু নাহিদ নয়, বিভাগের ১৯ আসনের আরও কয়েক হেভিওয়েট প্রার্থীও মনোনয়ন নিয়ে দোলাচলে আছেন। হাফ ডজন বর্তমান এমপি মনোনয়নের দৌড়ে আছেন গত কয়েক মাস আগে থেকেই। ইদানীং সিলেট ছেড়ে তারা ঢাকাতেই অবস্থান করছেন।
নির্বাচনি তোড়জোড় শুরুর আগেই তাদের আমলনামা দলীয় প্রধানের কাছে জমার পর এবারের মনোনয়ন নিয়ে তারা চরম সংশয়ে। এই হাফ ডজনের মধ্যে গত নির্বাচনের কয়েক নতুন মুখও আছেন। তারপরও মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও জমা দিয়েছেন প্রায় সবাই।
মর্যাদার আসন সিলেট-১ (সিলেট সিটি এলাকা-সদর উপজেলা) আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেছেন। তারপরও আওয়ামী লীগের তিনবারের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনসহ দলের তিনজন মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। তবে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে আছেন ড. মোমেন।
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনের বর্তমান এমপি গণফোরামের সভাপতি মোকাব্বির খান। এই আসনের জন্য তিনি এখনও নাছোড়বান্দা। এদিকে সাবেক সংসদ-সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীসহ আরও ৭ জন রয়েছেন মনোনয়ন দৌড়ে।
বিএনপির আলোচিত নেতা, বর্তমানে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে ভোটের মাঠে হটিয়ে নৌকার বিজয় অর্জন করা শফিকুরের নামই বেশি আলোচিত হচ্ছে। তবে আসনটি গত দুটি নির্বাচনে শরিকদের ছেড়ে দেওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ এই আসনের মুক্তিযোদ্ধাসহ আওয়ামী পরিবার।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য হাবিবুর রহমান, বিএমএর কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ ৬ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। এর মধ্যে এবার বেশ আলোচনায় রয়েছেন ডা. দুলাল। তবে আসনটিতে ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পার্টি।
সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। দলীয় আরও ৮ জন মনোনয়ন ফরম জমা দিলেও মন্ত্রী ইমরানকেই পছন্দ মাঠের নেতাদের।
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য, বর্ষীয়ান নেতা হাফিজ আহমদ মজুমদার এবার প্রার্থী হননি। তিনি প্রার্থী না হওয়ায় দলের মনোনয়ন চেয়েছেন আরও ৭ নেতা। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন ও ড. আহমদ আল কবীর রয়েছেন আলোচনায়। তবে জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, এই আসন এবার তাদের চাই-ই চাই।
সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) এই আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল বিএনপির শমসের মবিন ইদানীং ঘন ঘন এলাকা সফর করছেন আর বলছেন, এবারের এমপি তিনিই। এই আসনে শুধু নাহিদ নন, নির্বাচন মোকাবিলা করার আগে শমসের মবিনকে মোকাবিলা করতে হতে পারে আরও ১৩ সম্ভাব্য প্রার্থীকেও।
মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ি) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। তিনি এবার মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনসহ আরও ৪ জন।
মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ ৪ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে এই আসনে আরও দুই সাবেক এমপি তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে। তারাও নির্বাচন করতে চান এই আসনে। তারা হচ্ছেন ঢাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও সাবেক এমপি ও বিকল্পধারার নেতা এম এম শাহীন।
মৌলভীবাজার-৩ (রাজনগর-সদর) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য নেছার আহমদসহ আওয়ামী লীগের ৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এবারও এই আসনে নেছার আহমদ আলোচনার শীর্ষে।
সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ-তাহিরপুর-ধর্মপাশা-মধ্যনগর) আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। রতন নানা কারণে বহুল আলোচিত। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। একারণেই একটি আসনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১৭ জন। বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রার্থী এই আসনেই।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্তা। জয়ার ওপর স্থানীয় আ.লীগের ক্ষোভ অনেকদিনের। তাই এবার এই আসনে পরিবর্তন আসতে পারে। আলোচনায় আছেন আইজিপির ভাই শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের নাম।
সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। আরও ৩ জন নৌকার মনোনয়নপত্র নিলেও এলাকার উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখা মান্নানকেই চায় এলাকাবাসী।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের বর্তমান এমপি জাপার পীর ফজলুর রহমান। জাপা এবারও এই আসন চায়। তারপরও আওয়ামী লীগের ১০ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আসনটি জাপাকে না দিলে পিইসির চেয়ারম্যান ড. সাদিক অথবা জ্যেষ্ঠ নেতা মতিউর রহমান পেতে পারেন টিকিট।
মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ। এছাড়াও আরও ৫ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত এই আসনে প্রার্থী বদল হতে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়তে পারে উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমানের।
হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ গাজী। এবার ৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গাজী না পেলে ডা. মুশফিক বা কেয়া চৌধুরীই হতে পারেন নৌকার কান্ডারি।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমীরিগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান। এ আসনে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী ৯ জন হলেও প্রার্থী পরিবর্তনের কথা খুবই কম শোনা যাচ্ছে।
হবিগঞ্জ-৩ (সদর-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির। জাহিরের প্রতিপক্ষ গড়ে উঠায় নতুনরা মনোনয়নের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।
হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুব আলী। তিনিসহ ৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন ব্যারিস্টার সুমন।
সূত্র : যুগান্তর