মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মুজিববাহিনীর অন্যতম নেতা সিরাজুল আলম খানের ত্যাগ এবং অবদান মাথায় রেখেই এ লেখা, এ আলোচনা।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর ৩১শে জানুয়ারি অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠানে সিরাজুল আলম খান তারস্বরে স্লোগান ধরেছিলো বিশ্বে এলো নতুন বাদ-মুজিববাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ-জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। মুজিববাহিনীর অন্য তিন নেতা স্লোগান দেন নাই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে জাসদ গঠনের আগেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে শেখ মনিকে সদস্য করা এবং সিরাজুল আলমের প্রেসক্রিপশান না মানার কারণে এবং ছাত্রলীগের সিরাজ গ্রুপের ছাত্রলীগের সম্মেলনে না যাওয়ায় ছাত্রনেতাদের দিয়ে মাত্র মাস পাঁচেকের ব্যাবধানে সিরাজুল আলম খান, সিরাজপন্থী ছাত্রনেতাদের দ্বারা সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে এবং বক্তব্যে তীব্রভাবে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করেন। মুজিববাদ নামে কিছু নাই এগুলো অবাস্তব ইত্যাদি বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সমালোচনা থেকে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা সেখানে মুখ্য ছিলো।
যেই ১৫ দফা নিয়ে এতো কথা তার আদলে কিছু দফা প্রকাশ করা হয়েছিলো ২৫শে মে ১৯৭২ এ। যেখানে দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে গুলি করে মারার কথা বলা হয়। এই হলো একজন ছাত্রনেতার বুদ্ধি এবং পরিকল্পনা। অরাজক পরিবেশকে শুদ্ধ করার নামে প্রকাশ্যে গুলি করে অপরাধী হত্যার প্রেসক্রিপশানকে কোন সভ্য দেশেই সভ্য মত বলে কোন অবস্থায়ই ধরা যায় না।
১৯৭৪ এর ১৭ই মার্চ জাসদের যে মিছিলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার দিকে যায় এবং রক্ষীবাহিনী গুলি করে সেই মিছিল যে কোনদিকে যাবে তা জাসদের অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই জানতো না। এই প্ল্যান এবং বিভিন্ন অনুগত কর্মীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার মূল কারিগর ছিলেন সিরাজুল আলম খান। হাসানুল হক ইনু তার সে সময়কার খুব কাছের অনুসারী। জনশ্রুতি আছে এবং অভিযোগ আছে যে হাসানুল হক ইনু সেসময় প্রথমে গুলি করেছিলেন। তবে অকাট্য প্রমাণ আছে যে অনেক ছাত্রনেতাকেই সেদিন অস্ত্র নিয়ে আসার জন্যে বলা হয়েছিলো। সেই ঘটনায় জাসদ চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডের রাজনীতিতে এবং জাসদের অধিকাংশ নেতাকর্মী কিছু না বুঝেই সরকারের রোষানলে পড়ে।
অন্যদিকে জাসদের কর্মীদের বলা হয় গণবাহিনী তৈরি করে সরকারের সশস্ত্র মোকাবিলা করার জন্যে। একটা স্বপ্নকে এভাবেই গলাটিপে হত্যা করেন সিরাজুল আলম খান। শুরু হয় প্রতিহিংসার রাজনীতি, চোরাগোপ্তা হামলা এবং শ্রেণি শত্রু খতমের রাজনীতি। যাতে আগে জাসদ কখনোই যুক্ত ছিলো না।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সাথে কর্নেল তাহেরের যে যোগাযোগ ছিলো এটা সত্য। তাহের সেই প্ল্যানে ছিলেন কিনা তা জানা যায় না। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ করা এবং মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে ভারতের দালাল বানিয়ে উৎখাত করার ব্যাপারটায় সিরাজুল আলম খানের সায় ছিলো। ৭ নভেম্বর তাদের এই মেকানিজম মাঠে মারা গেলে সিরাজুল আলম খান আত্মগোপনে যান। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবির মধ্যে ১০ নং দাবি ছিলো ‘যেসব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে তাদের দেশে ফেরত আনার ব্যাবস্থা করতে হবে’; এরা কারা সে সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নাই। এই ধারা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সসম্মানে দেশে আনার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাসদের এই অস্থির রাজনীতির মাঝেও পুলিশ বাহিনীকে বলেছিলেন যে আমার সিরাজের যেনো কিছু না হয়। তার প্রতিদান হলো এই ১০ নং ধারা। একটা পর্যায়ে যেয়ে সিরাজুল আলম খান তীব্র ভারত বিরোধী হয়ে উঠেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত ভারতে যেতেন, চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়ি থাকতেন এবং ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
জেল থেকে জাসদ নেতারা ১৯৮০ সালে মুক্তি পেলে নতুন করে দল গোছানো আর গণকন্ঠ পত্রিকা পরিচালনার কাজ হাতে নেন সিরাজুল আলম খান। গণকণ্ঠের জন্যে লিবিয়ার দূতাবাস থেকে টাকা আনা হয় এবং গাদ্দাফীর গ্রিন বুকে বাংলা করে ছাপানো হয় যা আহমেদ ছফা করেন। লিবিয়ায় বসেই বঙ্গবন্ধুর খুনীরা দেশে এসে নতুন দল গঠনের কাজে হাত দেয় এবং সে কারণে দেশ থেকে অনেককে নিয়ে যেয়ে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।কর্নেল তাহেরের দুই ভাই সেখানে রিক্রুটিং এর কাজ করেন এবং মেজর জলিল এর সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের লিবিয়ায় পাঠানো হয়। এসব কিছুই সিরাজুল আলম খান জানতেন। এ সংক্রান্ত ঝামেলায় মেজর জলিলকে বহিষ্কার করা হলে সিরাজুল আলম খানকে উদ্দেশ্য করে মেজর জলিল এক খোলা চিঠি লেখেন, যেখানে সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে নানান গুরুতর অভিযোগ করেন।
সিরাজুল আলম খান নিজে এবং সিরাজপন্থীরা বিভিন্ন সময় সশস্ত্র যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ ইত্যাদির কথা বলতো এবং ৭ই মার্চের পরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেয়ে কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় নাই তাও জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পরেই মানে ১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি বাংলাদেশে আসেন। মুজিব বাহিনীর শীর্ষ চার নেতার মধ্যে একমাত্র শেখ ফজলুল হক মনি অস্ত্র হাতে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আপারেশন ঈগল নামক খণ্ড যুদ্ধে। সিরাজুল আলম খানসহ বাকি সবাই মোটিভেটর এবং প্রশিক্ষক হিসেবেই ছিলেন।
১৯৮৩ সালের ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর এবং দিপালী সাহা মারা যায়। এমন অবস্থায় সিরাজুল আলম খান বিবৃতি দিয়ে বলেন ‘পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহনশীলতার মনোভাব প্রয়োজন। ইহা সম্ভব কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে’। অনেকেই এ বিবৃতি দেখে হেসে বলেছেন স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সিরাজ খানের এলার্জি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতে তার কি দারুণ আয়োজন। এ যেনো ১৮০ ডিগ্রিতে ঘুরে যাওয়া দাদাভাই। অনেকেই অভিযোগ করেছেন এরশাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি এমন বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং অবস্থান নিয়েছিলেন।
ইন্ডিয়ান হাইকমিশন রেইডের ঘটনা (১৯৭৬) সিরাজুল আলম খান জানতেন এবং তার এক সময়কার বন্ধু বা সহযোদ্ধা মুবিনুল হায়দার চৌধুরী জানান উনি যখন সিরাজুল আলম খানকে বাচ্চা ছেলেগুলোকে হাইজ্যাকার বানানো নিয়ে চার্জ করেন তখন সে মুবিনুল হায়দারের হাত ধরে বলেছিলো ‘আমার কি কষ্ট হচ্ছে না? আমি তাদের কত ভালবাসতাম?’ এরশাদ এবং জিয়া দুজনের সাথেই সিরাজুল আলম খানের যোগাযোগ ছিলো। থাকাটা দোষের না কিন্তু সন্দেহ হয় তখনই যখন আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যে যে মেকানিজম হয় সেখানে সিরাজুল আলম খানের যোগসূত্র পাওয়া যায়।
সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো রাজনীতির রহস্য পুরুষের স্ববিরোধীতা, নিজেকে ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’র যোগ্য উদাহরণ হিসেবে তৈরি করা সিরাজুল আলম খানের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালীন সময়। অসংখ্য তরুণের মৃত্যু ছাপিয়ে তার এই দল ভাঙাগড়ার খেলার জন্যে কিংবা অযাচিত অতি বিপ্লবের জন্যে তাকে স্বাপ্নিক বিপ্লবী বলতে মন সায় দেয় না। এ যেনো এ বিপ্লবের রোগে আক্রান্ত এক সময়ের বিপ্লবীর করুণ পরিণতি।
ডা. মোহাম্মদ হাসান
চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক।
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।