দৈনিক মজুরী ১২০টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণের চার ঘণ্টা পর বেঁকে বসেছেন চা-শ্রমিকরা। এমনকি সমঝোতার মাধ্যমে আন্দোলন প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা-ও না মানার ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকদের একাংশ।
এমন বাস্তবতায় কমপক্ষে ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি না দিলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এর আগে ধর্মঘট শুরুর ১১তম দিনে শনিবার বিকেলে শ্রম অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। এসময় বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ‘দরকষাকষি’র পর একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়া হলেও তা মেনে নেন চা শ্রমিক নেতারা। এরপর রোববার থেকে পুরোদমে কাজে ফিরবেন বলেও ঘোষণা দেন তারা।
বৈঠক শেষে সরকারের প্রতিনিধি মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আসন্ন ভারত ও আমেরিকা সফর শেষে তিনি শ্রমিক নেতাদের নিয়ে বসবেন। তাদের কথা শুনবেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাসের প্রেক্ষিতে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এরপর চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখে তারা চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তবে এ ঘোষণার কিছুক্ষণ পর সমঝোতা না মানার ঘোষণা দেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সীদ্ধান্তকে আমরা সম্মান জানাই। ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর বিভিন্ন চা বাগান থেকে পঞ্চায়েত কমিটি ও ভ্যালী কমিটির নেতারা আমাদের ফোন দিয়ে জানান ১৪৫ টাকা মেনে নেওয়ার কারণে শ্রমিকরা বাগানে বাগানে আন্দোলন শুরু করেছেন। শ্রমিকরা এই সীদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না। তাই আমরা শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।
এদিকে বিকাল ৪ টায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের খবর শুনে এই ঘোষণা প্রত্যাখান করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু ধলাই ও লস্করপুর ভ্যালী ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণাটি প্রত্যাখ্যান করেন।
লস্তরপুর ভ্যালীর সাধারণ সম্পাদক অনিরুদ্ধ বাড়াইক বলেন, আমাদের লস্কর পুর ভ্যালীর ২৩ টি চা বাগানের বাগান পঞ্চায়েত নিয়ে আমরা বসেছিলাম। তারা কেউ ১৪৫ টাকা মজুরিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির মাত্র ৪জন লোক আমাদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা না করে এভাবে ১৪৫ টাকায় রাজি হলো কিভাবে বুঝলাম না। ৩০০ টাকা মজুরীর দাবীতে আমাদের আন্দোলন চলছে চলবে। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধর্মঘট ছাড়ছি না।
মনু ধলাই ভ্যালীর সভাপতি ধনা বাউরি, আমি একটি ভ্যালীর সভাপতি আমি আমার ভ্যালীর পঞ্চায়েত কমিটি বৃন্দের কাছে বলেছি, যদি একটি টাকাও বাড়ে তাহলে সবার সাথে আলোচনা করে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা সীদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু উনারা কিভাবে মাত্র ২৫টাকা জন্য রাজি হলেন। আমরা তাদের ঘোষনা প্রত্যাখ্যান করছি। আমাদের শ্রমিকরা ১৪৫ টাকা মানছে না। আমরা এই সীদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারছি না। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিতে চাই যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে থাকে তাহলে আমরাও স্বাধীন হয়ে বাচতে চাই। আমাদের কেন মানসিক ভাবে নির্যাতন করছেন।
তিনি বলেন, ‘করোনাকালে সব কিছু বন্ধ ছিলো আমাদের শ্রমিকরা করোনার ভয় কাটিয়ে কাজ করেছে। আমাদের শ্রমিকরা কত কষ্ট করে কাজ করে। আমরা এখন সীদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের ২৩টি চা বাগানে কাজ বন্ধ থাকবে। দাবী আদায়ে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা আমরা প্রত্যাহার করলাম।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি। এখন শ্রমিকরা যদি সেটা মেনে না নেয় আমরা তাদের কিভাবে বুঝাবো। চা শ্রমিকরা আমাদের প্রান, তারা আমাদের নেতা বানিয়েছে, তাদের সীদ্ধান্তের গুরুত্ব আমাদের দিতে হবে। আমরা শ্রমিদেকের পাশে আছি। সারাদেশে ধর্মঘট চলবে।
অন্যদিকে বৈঠকের পরপরই শ্রীমঙ্গলে শ্রম দপ্তরের সামনেই বিক্ষোভ করেন স্থানীয় চা শ্রমিকরা। বৈঠকের পর সিলেট মহানগরীর মালনিছড়া, হিলুয়াছড়া ও তারাপুর চা বাগানের শ্রমিকরাও এ সিদ্ধান্তকে বয়কট করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক শত চা শ্রমিক বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মালনিছড়া বাগানের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল করে আম্বরখানা হয়ে চৌহাট্টা পয়েন্টে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে তারা ঘরে ফিরেন। তবে ৩০০টাকা মজুরীর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এর আগে দুপুরে শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে চা শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী ও মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া।
অপরদিকে, শ্রমিকনেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল ও সিলেটের বিভিন্ন ভ্যালির শীর্ষ নেতারা।