‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের স্রষ্টাকে সম্মানী দেওয়া হবে

একতলা বাড়ির একটি কক্ষ। কক্ষে একটি বিছানা, সোফা ও টেবিল। এখানেই দিন কাটে হাওয়া সিনেমার ভাইরাল হওয়া ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের স্রষ্টা হাশিম মাহমুদের। এক সময় যার নিয়মিত পদচারণা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও চারুকলা ইনস্টিটিউটে, সেই তিনি নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন এই চার দেয়ালের মধ্যে। বিশেষ দরকার ছাড়া কোথাও বের হন না, মুড ভালো না থাকলে কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। ছোট্ট ওই ঘরের মধ্যেই তৈরি করে নিয়েছেন নিজের এক ভিন্ন জগত। সময় কাটে চিন্তাভাবনা করে, গান-ছড়া লিখে। টেবিলের খাতা ও ডায়েরিভর্তি তার লেখা গান ও ছড়া। মাঝে মধ্যে গান করেন। তবে গানের জগতের মানুষের সঙ্গে তার তেমন একটা যোগাযোগ নেই বললেই চলে।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তল্লা সবুজবাগ এলাকায় মা জামিলা আক্তার ও ছোট বোনকে নিয়ে হাশিম মাহমুদের বসবাস। বাবা আবুল হাশেম অনেক আগেই মারা গেছেন। তিনি বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। হাশিম মাহমুদ সাত ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ছয় ভাইবোন বিয়ে করলেও ৫১ বছর বয়সী এই শিল্পী বিয়ে করেননি।

হাশিম মাহমুদের ছোট বোন দিলারা মাসুদ ময়না বললেন, ‘হাশিম ভাই ভাবুক মানুষ। একটু এলোমেলো বলা যায়। নিজের মতো করে চিন্তা করেন, নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের। ইচ্ছে হলে কথা বলেন, না হয় বলেন না। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। যেমন আজ (বৃহস্পতিবার) সারাদিন খাতা-কলম নিয়ে কী যেন লিখেছেন। হয়তো গান কিংবা কবিতা। তিনি প্রায় ৯০টি গান লিখেছেন। গান লিখে তাৎক্ষণিক সেটা সুর করেন। এখনও লিখছেন। তবে কথাবার্তা কারও সঙ্গে বলতে চান না।’

এই প্রতিবেদক বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও একটি কথাও বলেননি হাশিম মাহমুদ। তবে গান গেয়ে শুনিয়েছেন।

দিলারা মাসুদ ময়না বলেন, ‘১৯৭১ সালে ভাইয়ের জন্ম। নারায়ণগঞ্জের লক্ষ্মীনারায়ণ সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও পরে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর থেকে চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু হয়। ছায়ানটে নজরুল গীতি ও রবীন্দ্র সংগীতের কোর্সে ভর্তি হন। তবে কোর্স সম্পন্ন করেননি। সেখানে আড্ডা ছিল। এখন সেখানে যান না। কেন যান না সে উত্তর আমার জানা নেই। নিজেও কখনও বলেননি।’

ভাই সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়া এখন সারাদিন ঘরে থাকেন। খুব একটা বাইরে যান না। আমরা নিয়ে গেলেই শুধু বের হন। আগে এমন ছিলেন না, স্বাভাবিক ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠন শাপলা, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ অনেক সংগঠনে যাতায়াত ছিল। নব্বইয়ের দশকে বৈরাগী নামে একটি ব্যান্ডদল করেছিলেন। লালনের আখড়ায় সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল। শুনেছি, সেখানে একটি মেয়েকে ভালো লেগেছিল। সে ভালোলাগা থেকেই সাদা সাদা কালা কালা গানটি লিখেছেন। সর্বপ্রথম ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বসে গানটি গেয়েছিলেন।’

হাশিম মাহমুদ শারীরিকভাবে অসুস্থ কিনা জানতে চাইলে দিলারা মাসুদ ময়না বলেন, ‘ঠিক অসুস্থ বলা যায় না। তবে খুব এলোমেলো। আগে স্বাভাবিক ছিলেন। ২০০৪ সালের পর নিজেকে আড়াল করতে শুরু করেন। এরপর থেকে কিছুটা অন্যরকম আচরণ লক্ষ্য করছি। ধীরে ধীরে এটি বাড়তে থাকে। গত ছয়-সাত বছর ধরে ঢাকায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপরও আমরা তাকে চিকিৎসক দেখিয়েছি। চিকিৎসক বলেছেন, কোনও রোগ নেই। তাকে বেশি করে সময় দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে একটু ভুলোমনের তিনি। এখন এটি একটু বেশি হয়েছে। তবে নিজের গান ও গানের লাইন কখনও ভুলেন না। অনেক সময় বলেন, আমার অনেক কিছু নিয়ে গেছে তারা। তবে সেটি কি তা মনে করতে পারেন না। তার মধ্যে এক ধরনের না পাওয়ার কষ্ট আছে।’

ভাবুক ও ভুলোমনের এই হাশিম মাহমুদ কিন্তু একবার একটি চাকরিতেও ঢুকেছিলেন। একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি হয়েছিল তার। এ প্রসঙ্গে দিলারা মাসুদ বলেন, ‘অল্প কিছুদিন চাকরি করেছেন। কাউকে স্যার ডাকতে পারবেন না বলে চাকরি ছেড়ে দেন। সবসময় গান নিয়েই আছেন, এখনও বিয়ে নিয়ে ভাবেননি।’

হাশিম মাহমুদের মা জামিলা আক্তার বলেন, ‘গানপাগল ছেলে আমার, সারাদিন গান করতো। এখন আর আগের মতো গান করে না, মন চাইলে গায়। আমি চাই, সে আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। আমি তাকে স্বাভাবিক দেখতে চাই। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন।’

হাওয়া ছবিতে গানের বিষয়ে দিলারা মাসুদ বলেন, ‘সাদা সাদা কালা কালা গানটির জন্য হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন গানের অনুমতি চাইলে, অনুমতি দেওয়া হয়। ভাইয়া এলোমেলো না থাকলে তাকে দিয়ে গানটি গাওয়ানো হতো। পরে অন্য একজনকে দিয়ে গানটি গাওয়ানো হয়েছে। গানটার জন্য ভাইয়াকে সম্মানী দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক। তবে এখনও দেননি।’

একসময় হাশিম মাহমুদের সঙ্গে পদাতিক নাট্য সংসদ নারায়ণগঞ্জ শাখায় কাজ করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহজাহান শামীম। তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালে হাশিম মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পদাতিক নাট্য সংসদ নারায়ণগঞ্জ শাখায় আমরা দুজন সদস্য ছিলাম। সেখানে তিনি গান করতেন। অস্বাভাবিক ভরাট গলার অধিকারী তিনি। সৃষ্টিকর্তা তাকে দারুণ গলা দিয়েছেন। সে সময়ে তিনি তরুণ। এখনও খুব ভালো গান।’

তিনি আরও বলেন, ‘নাট্যদলে একটা শৃঙ্খলা থাকে। কিন্তু হাশিম ভাই ওই সময় থেকে নিয়ম-কানুনের বাইরে চলতেন। নিয়ম-কানুন মানার লোক নন। ইচ্ছে হলে আসেন, না হয় আসেন না। তারপর একসময় নাট্যদলে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। এখন তিনি এলোমেলো। আমি দেখে অবাক হয়েছি। অথচ একসময় স্বাভাবিক ছিলেন। তার মতো শিল্পীর কদর করা খুব প্রয়োজন।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন