সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি : প্রধানমন্ত্রী

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে স্মরণ করে‌ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সংসদে বলেছেন, ‘তার মৃত্যু শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দলের পাশাপাশি জাতির জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী) চলে যাওয়ায় শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আমাদের দেশের ক্ষতি, জাতির ক্ষতি, এমনকি আমারও (ক্ষতি) হয়েছে।’

রবিবার (৩০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে সংসদ উপনেতা মরহুম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং সংসদ সদস্য শেখ এ্যানী রহমান, ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথসহ সাবেক একাধিক সংসদ সদস্য ও বিশিষ্টজনের মৃত্যুতে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি শুধু সংসদ উপনেতাই নন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাকে হারিয়ে আমাদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একজন সত্যিকার নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে হারালো। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই।’

তিনি বলেন, ‘যাদের সঙ্গে ছিলাম, একে একে সবাই ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বয়স হয়ে গেলে যেতেই হবে, হয়তো আমিও একদিন যাবো। তবে যে যেটা করেছেন (যার যার অবদান), সেটা আমাদের স্মরণ করতে হবে।’

চলার পথে সব সময় প্রয়াত সাজেদা চৌধুরীকে পাশে পেয়েছেন স্মরণ করে শেখ হাসিনা জানান, তিনি তাকে ফুপু বলে ডাকতেন এবং সত্যিকার অর্থে যেন তার ফুপুই তিনি ছিলেন এবং স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবার কথাও স্মরণ করেন।

তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার আমাদের আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতা-কর্মী।’ জাপার সাবেক চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদ, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ জাপা নেতাদের কারাগারে ন্যূনতম ডিভিশন না দিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখার মতো বেগম জিয়ার অত্যাচার-নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরী বা মতিয়া চৌধুরীকে গ্রেফতার করে জিয়াউর রহমান যেমন ডিভিশন না দিয়ে ফেলে রেখেছিল, খালেদা জিয়াও জাপা নেতাদের সঙ্গে একই কাজ করেছিল। অন্যদিকে সরকার মানবিক কারণে এবং তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে সাজা স্থগিত রেখে বেগম খালেদা জিয়াকে বাসায় থেকে চিকিৎসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা করা হয়েছে, যেহেতু তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অন্যদিকে বিএনপি সরকার সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান জামালউদ্দিনকে একটি ঘড়ি চুরির মামলা দিয়ে কোনও ডিভিশন না দিয়ে দুটি কম্বল দিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে ফেলে রেখেছিল। এভাবে মানুষকে তারা অত্যাচার করেছে।’

আওয়ামী লীগ সবার হাতে নির্যাতিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রথমে জিয়াউর রহমান, তারপর জেনারেল এরশাদ, তারপর খালেদা জিয়া। দফায় দফায় গ্রেফতার ও নির্যাতনে আমরা তো ভুক্তভোগী। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেহেতু জনগণের সংগঠন আর সাজেদা চৌধুরীর মতো অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা এই সংগঠনের হাল ধরে থেকেছেন বলে চরম দুঃসময়েও এই সংগঠন কখনও দিক হারায়নি, নীতি-আদর্শ নিয়ে এগিয়ে গেছে। তাই আমি আশা করি আমাদের যারা নেতৃবৃন্দ আছেন, তারা কিন্তু এই প্রয়াত নেতাদের আদর্শটা মাথায় রেখেই সংগঠনকে এগিয়ে নেবেন, সেটাই আমি চাই।’

সাজেদা চৌধুরীকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর সাজেদা চৌধুরীকে জিয়াউর রহমান যখন গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যায়, তখন তিনি অপারেশনের রোগী ছিলেন। তার পেটে ব্যান্ডেজ ছিলো। ঘা তখনও ভালো করে শুকায়নি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আমাদের নেতাদের ওপরই হামলা করে। গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়।’

জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘ওই সময় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয় জিয়াউর রহমান। তার শর্ত ছিল কারও নাম ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু সাজেদা চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর নাম দেওয়ার জন্য অটল ছিলেন। এ নিয়ে তাকে কারও কারও রুদ্ররোষেও পড়তে হয়েছে। সে সময় তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। আমি আসার পরও তিনি দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরী লতা-পাতা-ফুল প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। দেশকে বনায়নের জন্য তাকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিই। তিনি সেটা করেছিলেন। সুন্দরবনকে সাজানো ও রক্ষা করতে বিরাট ভূমিকা তিনি রেখেছিলেন। উপনেতা হিসেবে সজেদা চৌধুরী নিয়মিত সংসদে আসতেন। সংসদের কাজে তার খুবই আগ্রহ ছিল।’

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর জন্য ব্রিটেনের রানি প্রয়াত দ্বিতীয় এলিজাবেথের আলাদা আন্তরিকতা ছিল। কমনওয়েলথ সম্মেলনে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হতো।’ তিনি বলেন, ‘উনি বলতেন, আমাদের কমনওয়েলথ দেশগুলোতে নারী নেতৃত্ব খুব কম ছিল। এটা ওনার একটা আফসোস ছিল। পরিবেশ নিয়েও সচেতন ছিলেন তিনি।’

প্রধানমন্ত্রী রানির স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘একদিন তিনি (রানি) আমাকে বাকিংহাম প্যালেসের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। পুরো দেখালেন ও বললেন, দেখো কি আশ্চর্য সবাই এ রকম বোতলগুলো সাগরে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করছে। এটার কিছু একটা করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। কমনওয়েলথের মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করতেন।’

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ স বসময় তার খোঁজখবর নিতেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘উনি (প্রয়াত রানি) আমাকে, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের তিনজনকে দেখেন। তখন বললেন, ‘তোমরা তিনজনই দ্বিতীয় প্রজন্ম।’ ওনার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় সদ্য প্রয়াত সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য শেখ এ্যানি রহমানের সম্পর্কেও স্মৃতিচারণা করেন।

স্পিকার এ-সংক্রান্ত শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করলে জাতীয় সংসদ তা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। পরে এক মিনিট নীরবতা পালন ও দোয়া করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন হাফেজ রুহুল আমিন মাদানী।

চলতি সংসদের কোনও সংসদ সদস্য মারা গেলে সংসদে শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনা করে রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের বৈঠক মুলতবি করা হয়। স্পিকার ড. শিরীর শারমিন চৌধুরী পরে অধিবেশন মুলতবি করেন।

প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন সরকারি দলের আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মুহাম্মদ ফারুক খান, শাজাহান খান, আসম ফিরোজ, শ ম রেজাউল করিম, ওয়াসিকা আয়শা খান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদ উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা প্রমুখ।

সূত্র : বাসস