সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা কী কাজ করেন

যেকোনও অপরাধে বিচার শেষে সাজা হওয়ার সময় সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড উল্লেখ করা হয়। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা আসলে কারা অভ্যন্তরে কী কাজ করেন? কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা কয়েদি ও সারা দেশের বিভিন্ন কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারা অভ্যন্তরে যাবতীয় কাজে সহযোগী হিসেবে কয়েদিরা কাজ করে থাকেন। তাদের কাজের নাম ও যারা যে কাজ করেন, সেই অনুযায়ী বছরের পর বছর ধরে ব্যক্তির পরিচয়ও তৈরি হয়েছে। যার সঙ্গে বাইরের জগতের কোনও মিল নেই। বুঝিয়ে না দিলে এসব শব্দের মানেও বুঝবে না বাইরের মানুষ।

কারা কর্মকর্তারা জানান, কারাগার পরিচালনায় যেসব রুটিন ওয়ার্ক আছে, তার সবই করেন সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা। হাজতিদের (যাদের সাজা হয়নি, বিচার চলছে) দেখাশোনা করা, ওয়ার্ড ইনচার্জ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, খাবার বণ্টন, সাক্ষাতে কেউ এলে হাজতি বা কয়েদিদের ডেকে দেওয়া, কেস টেবিল (কারাগারে যাওয়ার পরের দিন খুব সকালে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো) পরিচালনায় সহযোগিতা, সবই তাদের করতে হয়। এই কাজগুলো যারা করেন, তাদের আলাদাভাবে ডাকার রেওয়াজও তৈরি হয়েছে।

প্রতিটি কাজের সঙ্গে চালি বা দফা শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। যে ঝাড়ু দেয়, তাকে এলাকাভেদে কারা অভ্যন্তরে হয় ‘ঝাড়ুচালি’ বা ‘ঝাড়ুদফা’ বলা হয়। সাধারণ ওয়ার্ডে টুকটাক ফরমাশ খাটে যারা, তাদের ‘ফালতু’, যে মোড়া বানায় তাকে ‘মোড়াচালি’, যারা সাক্ষাৎকক্ষে হাজতিদের ডাকে তাদের ‘কলিং’, কেসটেবিলে যারা লেখে বা যাবতীয় হিসাব রাখে তাদের ‘রাইটার’ নামে ডাকা হয়।

কে কী কাজ করবে কীভাবে নির্ধারণ হয়
সিরাজগঞ্জের জেল সুপার আ. বারেক বলেন, এ এক অন্য জগৎ। কারাগারের ভেতরের সব কাজ সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরাই করে থাকেন। আদালত যখন সশ্রম সাজা দেন, তখন কিছু না কিছু করাতেই হয়। কাজ করলে সাধারণ বিচারাধীন বন্দিদের থেকে ভাত-রুটির পরিমাণ বেশি দেওয়া হয়। ৬ মাসের বেশি যাদের সাজা, তাদের সাজার চার ভাগের এক ভাগ মওকুফ হওয়ার সুযোগের কারণেও কাজটা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, শারীরিক সামর্থ্য নিরূপণ করেন কারা চিকিৎসক। তারপর দেখা হয় শিক্ষাগত যোগ্যতা। এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কাজ বণ্টন করে দেন জেলার। কাজ করার বিনিময়ে তারা পোশাকও পায়।

জয়পুরহাট কারাগারের জেল সুপার রীতেশ চাকমা বলেন, কাজের ধরন এক হলেও একেক কারাগারে একেক নামে ডাকার প্রবণতা আছে। যারা ডাকাডাকি করেন কলিং রাইটার, একটু শিক্ষিতদের স্কুলের শিক্ষকতা, বাগানে শাকসবজি ফলানো, রান্নার কাজ বন্দিরাই করে। ওয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা করে যারা তাদের ম্যাট, হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজ, আর বড় কারাগার—যেখানে উৎপাদন বিভাগ থাকে সেখানে কয়েদিরা বেতের কাজ, কাপড়ের কাজ করে থাকে।

সাত মাস কারাগারে থেকে বের হয়ে আসা এক আসামি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কারাগারের বাইরে থেকে ভেতরের জীবন বুঝতে পারার কোনও সুযোগ নেই। সেখানে একেক কাজ একেক কয়েদি সামলায়। সেখানেও শক্ত কাজ, দুর্বল কাজ আছে। যারা ফুটফরমাশ খাটে সেই ‘ফালতু’দের বেশি দরকার, কিন্তু তাদের ক্ষমতা কম। ‘কেসটেবিলে’ কাজ করে যারা তাদের দাপট বেশি। কাউকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নিতে চাইলে টাকা, বিড়ি বা শুকনো খাবার দিলেই চলে। একজনের কাজে আরেকজন হস্তক্ষেপ করে না।

মাছি মারাও একটা কাজ
যারা বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল তাদের জন্য হালকা কাজের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের ‘মাছিচালি’ বা ‘মাছিদফা’ বলা হয়। একটা লাঠির মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে তাতে গুড় ছিটিয়ে বসে থাকেন কখন মাছি বসবে। মাছি বসলে স্কেলের মতো লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে সেটাকে জর্দার কৌটায় ভরে রাখা হয়। কারা এলাকায় এমনিতে মাছির উপদ্রব থাকে। এটাকে ছোট কাজ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বয়স্কদের বাগানের কাজ বলে একটা কাজে যুক্ত আছেন—এমন দেখানো হয়। কেননা, আদালত সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পরে এটা মানতেই হবে। কিন্তু যখন দেখি শারীরিক সক্ষমতা নেই তখন কিছু একটার সঙ্গে তাকে যুক্ত রাখা হয়। না হলে তারই ক্ষতি। কাজ না করলে সাজা মওকুফ হবে না।

সুঠাম দেহের কয়েদিরা ধোপা
ধোপার কাজে শক্তি লাগে বলে এই কাজ তাদেরই দেওয়া হয়—যারা সুঠাম দেহের অধিকারী। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, এই কাজ যেহেতু কায়িক শ্রম বেশি, এর আগে অবশ্যই তার স্বাস্থ্যগত পরামর্শ চিকিৎসকের কাছ থেকে নেওয়া হয়। তারা যদি পরামর্শ দেন, তবেই সেই কাজ দেওয়া হয়। সুঠাম দেহের অধিকারীদের রান্নার কাজও দেওয়া হয়। এতজনের রান্না করার ধকল আছে। রান্না ও বণ্টনের কাজটি মিলিয়ে বেশ অনেক সময়ের কাজ। অনেকে মিলে একটি টিমের মতো কাজটা হয়। সেই কাজে কেউ গাফলতি করলে সেগুলো আবার পরের দিন সকালে কেসটেবিলে (যাবতীয় পরিকল্পনা ও অভিযোগের জায়গা) তোলা হয়।

বয়স্কদের কাজ বাগানে ঘোরা
বয়স্কদের সাধারণত কাজ দেওয়া হয় না। কিন্তু সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া কেউ যদি কাজ না করে তাহলে আদালত অবমাননা হয়। সে কারণে তাদের বাগানে কাজ লেখা থাকে কিন্তু তেমন কঠিন কিছু করতে হয় না। হয়তো মরে যাচ্ছে এমন কোনও গাছের জন্য পরামর্শ দেন মালিদের, বাগানে নিড়ানো দরকার কোথায় সেগুলো দেখিয়ে দেন। উনারা কী কাজ করছেন সেই কাজ আবার লিখিত থাকা লাগে। সেসবই মানবিকতার সঙ্গে বিবেচনা করা হয় বলে জানান জেলফেরত ব্যক্তিরা।

নামগুলো কারা দিলো
সাত বছর কারাবাস করে ফেরা এক আসামি বলেন, এই নামগুলো বছরের পর বছর চলে আসছে। পুরোনো কয়েদিরা নতুনদের শেখায়ে দেয়। বেশিরভাগই ইয়ার্কির ছলে, নিজেদের বুদ্ধিতে নাম দিয়েছে। নাম নতুন নতুন যুক্তও হয়। যারা হাজতিদের দেখভাল করে তাদের ‘ফালতু’ এবং যারা ডিভিশনপ্রাপ্তদের দেখভাল করে তাদের ‘সেবক’ বললেও উভয় ক্ষেত্রেও ‘ফালতু’ বলা হয়ে থাকে।

এই যে কাজ অনুযায়ী নাম দেওয়া এটা কয়েদিরা নিজেরা নানা সময়ে দিয়েছে বলে জানান বরিশাল বিভাগের কারা উপ-পরিদর্শক টিপু সুলতান। কারাগারে কাজে ঢোকার আগে কখনও এই নামগুলোর বিষয়ে শুনেছেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রত্যেক সমাজ, পেশায় নানা ধরনের নামের ও নিজেদের ভাষার রেওয়াজ আছে। ফলে সেই অনুযায়ী কারা অভ্যন্তরেও তেমন দেখা যায়। কারাগার যেহেতু নিয়ন্ত্রিত এলাকা, তাই বাইরের মানুষের জানা নেই।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন