সংগ্রামে-ইতিহাসে ছয় দফা, একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছয় দফা ছিলো এক অনন্য অসাধারণ সোপান। ছয় দফার আগ পর্যন্ত সামরিক জান্তার বিপক্ষে, ধর্মের নামে অধিকারহরণকারী পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে কিংবা বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ একক নেতৃত্বে ছিলো না। বাম দলগুলো নানান ভাগে বিভক্ত। চুন থেকে পান খসলে তর্ক যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। মাও টুপি মাথায় দিয়ে পিকিংপন্থী কিংবা লেলিনবাদের উপর বক্তব্য দিয়ে মস্কোপন্থী হওয়ায় ব্যস্ত। কেউ কেউ বুনছে গেরিলা হবার স্বপ্ন। সাম্প্রদায়িক ধর্মজীবি দলগুলো ছিলো তাদের স্বপ্নে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেই। নেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। মোনেম খানরা ব্যস্ত আইয়ুবের পদলেহনে। এমন একটা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিয়ে আসলেন লিখিত, সহজবোধ্য দাবী যা ছিলো বাঙালির বাঁচার দাবী।


এখন ছয় দফা আছে স্কুলের বাচ্চাদের রচনা লেখায়, ছয় দফার ইতিহাস আছে বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষায় কিংবা রাজনৈতিক জনসভায়। ছয় দফার ইতিহাস থাকা উচিত মননে, সত্ত্বায় এবং বাস্তবতায়।


এখনকার দিনে অধিকাংশ মানুষ নেতাগিরি বলতে বুঝে সেল্ফিবাজি, গলার রগগুলোকে অশেষ কষ্ট দিয়ে শ্লোগান দেওয়া, হাতাহাতি এবং মারামারিতে পারদর্শী হওয়া, ব্যানারে পোস্টারে সুন্দর একখানা বাবু মার্কা ছবি দিয়ে হাটে বাজারে টানানো, অমুক তমুকের জন্মদিনে মিথ্যা গালভরা প্রশংসা লিখে শুভেচ্ছা জানানো, পিকেটিং করা কিংবা কর্কশ কন্ঠে আকাশ পাতাল এক করে ফেলা বক্তব্য দেওয়া। এগুলো নেতার বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এগুলোকে নেতার গুন বলে ধরা যেতে পারে কিন্তু নেতার প্রধান গুন হলো ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। নেতার গুন হলো লক্ষ্য স্থির করা। সামনের দিনগুলো দেখতে পারা। জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা, জনগণের চাওয়াটা জানা কিংবা জনগণকে রাজপথে নামানোর পথটা জানা। আর কোন রাজনীতিবিদ কিংবা কোন দল বাঙালির পালসকে ধরতে পারেনি সেই সময় আওয়ামী লীগের মতো করে।

বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন তার দেশ স্বাধীনের পথে তাকে জনসম্পৃক্ত আন্দোলন করতে হলে কি করতে হবে। ছয় দফার মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো শ্রমিক এবং ছাত্র একসাথে আন্দলোনে জোট বাঁধে। পরে যুক্ত হয় কৃষক শ্রেণী। ৬৬ সালের ছয় দফা না আসলে হতো না ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন। হতো না সকল শ্রেণী পেশার ঐক্য। ছয় দফা না হলে লৌহমানব খ্যাত সামরিক সরকারের প্রধান আইয়ুব খান তাসের ঘরের মতো বঙ্গবন্ধুর সামনে থেকে উড়ে যেতো না। গ্রামে গঞ্জে ছয় দফার আলোচনা আর চা চক্র না হলে খেটে খাওয়া মানুষ মুজিব ভাইয়ের কথায় রাস্তা আটকে দিতো না। ছয় দফা না হলে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব দলকে পিছনে ফেলতে পারতো না। বঙ্গবন্ধুর মাথা থেকে বের হওয়া ছয় দফা ছিলো রাজনৈতিক ভিশন। ছিলো আওয়ামী লীগ এর জনপ্রিয়তার সিঁড়ি।

ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ-এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?’ আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব : ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ ভবিষ্যৎ দেখতে না পারলে কিংবা বলা যায় অবাধ দূরদর্শিতা না থাকলে এভাবে ভাবা কি সম্ভব?

আইয়ুব খান বিরোধিতা করেছে, রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে জেলে নিয়েছে। মোনেম খান বলেছে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। জামাতে ইসলামি বলেছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। স্বঘোষিত গেরিলারা বলেছে আই ওয়াশ।মাওলানা ভাসানী বলেছে সিআইএ এবং আমেরিকার ষড়যন্ত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মাইকে, কথায়, মিছিলে, প্ল্যাকার্ডে বলেছে ছয় দফাই বাঙালির বাঁচার আশা। মানুষ ছয় দফাকে গ্রহণ করেছে বাকি সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।

ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন: ‘আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?’ এগুলো করার জন্যে অনেক হিসাব কষে এগিয়েছিলো বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগ এর দলীয় ফোরামে ছয় দফার কথা বলেন তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে মিটিং এর আশেপাশে সিরাজুল ইসলাম খানকে চেলা কাঠ হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। তরুণ রাজনীতিবিদরা এবং ছাত্রনেতারা সবসময় বঙ্গবন্ধুর সাথেই ছিলেন। এখনকার সময়ে শুধু কল্পনা করেন যে রাস্তা নাই, পথ নাই, যানবাহন নাই কিন্তু একটা মানুষ তার মতাদর্শ নিয়ে হেঁটে চলেছেন।

মুসলিম লীগের বলয় ভেঙে, আইয়ুবের হুলিয়া মাথায় নিয়ে, সাম্প্রদায়িক শক্তির ঘেটুপুত্রদের পাশ কাটিয়ে কিংবা জনবিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক বামদের শ্লেষাত্মক মন্তব্যগুলো মনে নিয়ে হাটে বাজারে, গ্রামে গঞ্জে, মাঠে ঘাটে মানুষের কাছে যাওয়া কতোটা কঠিন। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর পাশে সেই সময়কার অন্য সকল নেতার আকৃতি ছোট হয়ে গিয়েছে দিনে দিনে। তবে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্য শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক যারাই সাথে ছিলেন সবাই ইতিহাসে অনন্য।

শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকা হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি শহিদ হন। ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া।

এখন ছয় দফা আছে স্কুলের বাচ্চাদের রচনা লেখায়, ছয় দফার ইতিহাস আছে বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষায় কিংবা রাজনৈতিক জনসভায়। ছয় দফার ইতিহাস থাকা উচিত মননে, সত্ত্বায় এবং বাস্তবতায়।

ছয় দফা বঙ্গবন্ধুকে করেছিলো দলে সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা এবং সেই সময়কার বাংলাদেশের সবচেয়ে যোগ্য রাজনীতিবিদ। কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাধনা এবং দূরদর্শিতা থাকলে এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া সম্ভব? কতোটা ইচ্ছেশক্তি থাকলে এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করা যায় তা বুঝতে হবে।

তাই তো বঙ্গবন্ধু বলতে পেরেছেন ‘ছয় দফা আজ আমার না, আওয়ামী লীগের না, ছয় দফা আজ বাঙালির। কেউ ছয় দফার সাথে বেইমানি করলে তাঁকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। আমি যদি করি আমাকেও।’

আজ সেই ছয় দফা দিবসে আরেকবার চিন্তা করুন মুক্তিকামী রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে।

ডা. মোহাম্মদ হাসান
চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক।
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।