‘শেয়ারবাজার দুরবস্থার জন্য ভ্যাট-করকে দায়ী করা ঠিক নয়’

শেয়ার বাজারের দুরবস্থার জন্য ভ্যাট ও কর ছাড়া অন্য কি কারণ রয়েছে তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

শেয়ার বাজার দরপতনের জন্য বার বার কর ও ভ্যাটকে দায়ী করা হলেও তা পুরোপুরি ঠিক নয় জানিয়ে কালো টাকা সাদা করার জন্য শেয়ার বাজার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আরো সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত বলে জানান তিনি।

বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সিলেটে ২০২৩ -২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপলক্ষ্যে প্রাক বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান।

এসময় তিনি বলেন, ‘সিলেট চেম্বার অব কমার্স সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে জাতীয় বাজেটে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়। এসব বাজেট প্রস্তাবনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদেরকে বাজেট প্রণয়ন করতে হয় সমগ্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে। তাই সকল প্রস্তাব বিবেচনা করা সম্ভব হয় না। তবে সিলেট চেম্বারের প্রস্তাবগুলো আমরা বিবেচনার আন্তরিক প্রচেষ্টা করে থাকি।’

এনবিআর চেয়ারম্যান আরো বলেন, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে সুন্দর একটি প্রাক-বাজেট আলোচনা সভা আয়োজন ও বাজেট প্রস্তাবনা পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছে। কোন সংগঠন বা ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পূরক প্রস্তাবনা থেকে থাকলেও পরবর্তীতে তাও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে প্রেরণ করতে পারবেন।

তিনি বলেন, ”ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অডিটের জন্য আমরা ‘সেকেন্ডারি ডাটাবেজ অডিট সিস্টেম’ চালু করতে যাচ্ছি। এটি চালু হলে অডিট প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজতর হবে।”

দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে দেশীয় শিল্পগুলো স্থানীয় চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি না এবং তা সহজলভ্য কি না। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই করদাতাদের ভয়-ভীতি দূর করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কাজ করে যাচ্ছি।’

তিনি ব্যবসায়ীদের স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাগুলো নিরসনের লক্ষ্যে কাস্টম্স কমিশনার ও কর কমিশনারের কার্যালয়ে যোগাযোগের অনুরোধ জানান।

আলোচনায় অংশ নেন, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা, সিলেট বিভাগের ৪টি চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ীরা। এসময় ব্যবসায়ী নেতারা বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

বিশেষভাবে অর্জিত লভ্যাংশের উপর আরোপিত কর হ্রাস করে ১৫% নির্ধারণ করার অনুরোধ, লিস্টেড ও নন লিস্টেড কোম্পানির কর্পোরেট কর ২.৫% হ্রাস করার প্রস্তাব জানান তারা।

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক নীতি) মাসুদ সাদিক, সদস্য (আয়কর নীতি) সামস্ উদ্দিন আহমেদ ও সদস্য (মূসক নীতি) জাকিয়া সুলতানা।

তারা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে সুন্দর বাজেট প্রস্তাবনাটি তৈরীর জন্য দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিকে ধন্যবাদ জানান এবং আসন্ন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রস্তাবনাগুলো যথাযথভাবে বিবেচনার আশ্বাস প্রদান করেন।

সভাপতির বক্তব্যে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও এফবিসিসিআই এর পরিচালক তাহমিন আহমদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। আমরা আশাবাদী ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবো।’

তিনি বলেন, ‘সিলেটে তেমন কোন বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত আমদানি, পর্যটন ও ট্রেডিং ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে বিগত কয়েকবছর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি ও পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল থাকায় সিলেটের ব্যবসায়ীরা এসময় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন। তার উপর গত বছরের প্রলয়ংকারী বন্যা ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সিলেটের ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে রয়েছেন। এমতাবস্থায়ও ভ্যাট বিভাগের পক্ষ থেকে সিলেটের ব্যবসায়ীদেরকে বর্ধিত হারে ভ্যাট প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

সিলেটের ব্যবসায়ীরা বরাবরই ভ্যাট, ট্যাক্স প্রদানে আগ্রহী উল্লেখ করে চেম্বার সভাপতি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোপূর্বে একাধিকবার সিলেট চেম্বারের মাধ্যমে সিলেটের ব্যবসায়ীগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের ভয়াবহ বন্যা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দার কারণে সিলেটের ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাই সিলেটের ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের সহমর্মিতামূলক মনোভাব রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তিনি আগামী বাজেটে কোনরকম ভ্যাট, ট্যাক্স বৃদ্ধি না করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতি অনুরোধ জানান।

এছাড়াও তিনি সিলেট থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিমানযোগে সরাসরি পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে সিলেটে প্যাকিং হাউজ নির্মাণ, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যাগেজ সিস্টেম পুণরায় চালু, ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকায় বর্ধিতকরণ, সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীপথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি চালু, উপজেলা পর্যায়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে রাজস্ব কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাস করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন।

সভায় বক্তাগণ ভোগ্যপণ্য পরিবেশকদের নিকট হতে ভ্যাট আদায় না করা, বিসিক শিল্প মালিকদের ভ্যাট হ্রাস করা, স্থলবন্দর ও এলসি স্টেশন সমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সমস্যা দূর করা, ইটভাটা মালিকদের ভ্যাটের কিস্তি পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করা, কোর্ট ফি ডকুমেন্টের অপ্রতুলতার জন্য অনলাইনে কোর্ট ফি আদায়, ভ্যাটের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন, সিলেট চেম্বারের সিনিয়র সহ সভাপতি ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ, সহ সভাপতি মো. আতিক হোসেন, কাস্টম্স এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সিলেট এর কমিশনার মো. আকবর হোসেন, কর অঞ্চল-সিলেট এর কর কমিশনার সৈয়দ জাকির হোসেন, সিলেট চেম্বারের পরিচালক ও ভ্যাট, বাজেট, শুল্ক, কর ও ট্যারিফ সাব কমিটির ডাইরেক্টর ইনচার্জ আবু তাহের মো. শোয়েব, চেয়ারম্যান ও পরিচালক মো. হিজকিল গুলজার, অতিরিক্ত কর কমিশনার হেমল দেওয়ান, অতিরিক্ত কাস্টম্স কমিশনার মুহাম্মদ রাশেদুল আলম, সিলেট ওমেন্স চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি স্বর্ণলতা রায়, সিলেট চেম্বারের পরিচালক জিয়াউল হক, মুজিবুর রহমান মিন্টু, আলীমুল এহছান চৌধুরী, প্রাক্তন সিনিয়র সহ সভাপতি শাহ আলম, সাবেক সহ সভাপতি মো. দিলওয়ার হোসেন, মো. এমদাদ হোসেন, সাবেক পরিচালক পিন্টু চক্রবর্তী, এহতেশামুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা সিএন্ডএফ এজেন্ট গ্রুপের সভাপতি মো. বশিরুল হক, ভ্যাট, বাজেট সাব কমিটির কো-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাজাহারুল হক, সিলেট জেলা কর আইনজীবী সমিতির সহ সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল আলীম পাঠান, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক নাঈম সরফরাজ ও প্রতিনিধিবৃন্দ, সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র পরিচালক নুরুল ইসলাম ও প্রতিনিধিবৃন্দ, সিলেট চেম্বারের সচিব মো. গোলাম আক্তার ফারুক ও কর্মকর্তাবৃন্দ, সিলেটের বিভিন্ন মার্কেট ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সিলেটের গণ্যমান্য ব্যবসায়ীবৃন্দ।

সভা সঞ্চালনা করেন সহকারী কর কমিশনার অর্পা বণিক ও সিলেট চেম্বারের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মিনতি দেবী।