শিক্ষা ও গবেষণায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা, উদ্ভাবনা, শিক্ষার মান ও গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় শতভাগ কর্মসংস্থান বিবেচনায় দিন দিন উন্নতি লাভ করে চলেছে। সংক্ষেপে সাস্ট (SUST) নামে বহুল পরিচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নানান কারণে এক অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বাংলাদেশের প্রথম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এখন সারা দেশে এই মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪টি। এছাড়াও সাস্ট বাংলাদেশে প্রথম সমন্বিত অনার্স কোর্সের প্রবর্তক। আমেরিকান ক্রেডিট সিস্টেম চালুর ক্ষেত্রে পথিকৃত্। ১৯৯৬-১৯৯৭ সেশন থেকে চালু হওয়া সেমিস্টার সিস্টেম এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুল প্রচলিত ও অনুসৃত। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি ভাষা কোর্সের পাশাপাশি দুটি কম্পিউটার কোর্স করাও বাধ্যতামূলক।

সাস্ট তথ্যপ্রযুক্তিতে (Information Technology) দক্ষতাসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ডিজিটালের পর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম পথপ্রদর্শক। এটি দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়—যার ক্যাম্পাস পুরোটাই ফ্রি ওয়াইফাই অ্যাকসেস সম্পন্ন। হলগুলোতে ওয়াইফাইয়ের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে রয়েছে নিজস্ব মনিটরিং অ্যাপস। সাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় মোবাইল রেজিস্ট্রেশনের উদ্ভাবক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রমের অগ্রদূত এবং গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রমে টানা তিন বছর ধরে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে শীর্ষস্থানে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ৯০ লাখ, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯ কোটি টাকা। ২০১৬ সালেই SCIMAGO ইনস্টিটিউশন র‍্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। ২০১৮ সালে NASA স্পেস অ্যাপস প্রতিযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবন-সংক্রান্ত সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে প্রথম বারের মতো ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অব ভাইস-চ্যান্সেলর’-এর আয়োজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য যে গবেষণা ও নতুন নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন—সে ব্যাপারে আমরা সজাগ ও সচেতন। ভবিষ্যতে আমরা বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে থাকতে চাই। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ওপরের সারিতে থাকা সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশড প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমানকে আমরা দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি বহু বছর ধরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। অনার্স থেকেই আমরা গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাশ করে বের হচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো প্রকাশনা থাকে। ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে Q এবং Q2 জার্নালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪৮১টি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়।


পহেলা ফাল্গুন যেমন বসন্ত ঋতুর প্রথম দিন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তেমনি বাংলাদেশের অষ্টম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যািলয়ের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও। ওই দিন ক্যাম্পাসে গ্রহণ করা হয় বিশেষ কর্মসূচি। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৬ সালে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালে এর ছিল তিনটি বিভাগ- পদার্থ, রসায়ন ও অর্থনীতি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২০৫ ও ১৩ জন। সেখান থেকে বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ৬২০ জন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯০৬৫ জন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ অ্যাফিলিয়েটেড ১২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানেও রয়েছে ৪০০০ শিক্ষার্থী।

গত কয়েক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার মানোন্নয়নের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য যে গবেষণা ও নতুন নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন—সে ব্যাপারে আমরা সজাগ ও সচেতন। ভবিষ্যতে আমরা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে থাকতে চাই। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ওপরের সারিতে থাকা সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশড প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমানকে আমরা দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি বহু বছর ধরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। অনার্স থেকেই আমরা গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাশ করে বের হচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো প্রকাশনা থাকে। ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে Q এবং Q2 জার্নালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪৮১টি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ৭৫ জন তরুণ শিক্ষক বৃত্তিসহ যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষার জন্যে গিয়েছেন। গবেষণাকর্মে চৌর্যবৃত্তি বন্ধে প্ল্যাজিয়ারিজম নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডোপ টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এখানকার হলগুলোতে কোনো বহিরাগত শিক্ষার্থী নেই। মাদক বা নারী নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সাস্ট ক্যাম্পাসকে ইতিমধ্যে র্যাগিংমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে কোনো সেশনজট নেই। ৩০ দিনের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এজন্য রেজাল্ট প্রসেসিং সফটওয়্যারের গতি ও কার্যক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। হালনাগাদ করা হয়েছে সেমিস্টার সিস্টেম অর্ডিন্যান্স। দ্রুত ফল প্রকাশের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করে থাকেন। করোনাকালে আমরাই প্রথম অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া শুরু করি। অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার সুবিধার্থে আমরাই প্রথম শিক্ষার্থীদের মাসে ১৫ জিবি ইন্টারনেট ডাটা এবং ৩ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সিলেটবাসীকে করোনার টিকা প্রদানের জন্যে RT-PCR ল্যাব প্রতিষ্ঠা করি। বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১০৭টা স্টুডিও টাইপ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ চা বাগানে কর্মরত তথা পিছিয়ে পড়া শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য দেশে প্রথম বারের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোটা ও তাদের নিয়মিত বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের সুবিধার্থে প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে স্মার্ট বোর্ড সরবরাহের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গবেষণার জন্য প্রদান করা হচ্ছে ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড। শিক্ষকদের জন্য আইইএলটিএস/জিআরই/জিম্যাট ইত্যাদির জন্য চালু করা হয়েছে বিশেষ অনুদান। গবেষকদের প্রণোদনা জন্য ৫০ লাখ টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করা হয়েছে। পেপারলেস অফিস ব্যবস্থাপনা কার্যকরের লক্ষ্যে সব অফিস ও বিভাগকে আনা হয়েছে ডি-নথির আওতায়। এর ফলে, বিদেশে অবস্থান করেও সংশ্লিষ্টরা অফিসের ফাইলে স্বাক্ষর করতে পারেন এবং এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সহজ, স্বচ্ছ ও গতিশীল হয়েছে। ক্যাম্পাস সবুজায়নের লক্ষ্যে ৯০ হাজারেরও বেশি ফলজ, ঔষধি ও বনজ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। আরো ১০ হাজার গাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ৫ হাজার মূল্যবান আগর গাছ রোপণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ টিলাসহ পুরো ক্যাম্পাস এসেছে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। অত্যাধুনিক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কাজ শেষ হয়েছে। মেধার ভিত্তিতে উক্ত হলের আসন বণ্টন করা হয়েছে এবং বর্তমানে ছাত্রীরা হলে অবস্থান করছে। ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ ও ‘ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি’ (বর্ধিত ভবন) খুব শীঘ্রই শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ ব্যবহার করতে পারবেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজও সমাপ্ত প্রায় এবং এটি বরাদ্দের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঢাকায় একটি অত্যাধুনিক গেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবহন পুলের গাড়িগুলোর যথাযথ ব্যবহারে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ অ্যাপস। হলগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসে আমরা আশা করি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে উত্তরোত্তর দেশমাতৃকার মুখোজ্জ্বল করবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এ যাবত্ নানানভাবে অবদান রেখেছেন, আজ আমরা তাদের গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। মহামান্য চ্যান্সেলর ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথাযথ নির্দেশনা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যান্টস কমিশনসহ (UGC) যারা আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা প্রদান করছেন, তাদের প্রতিও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

  • প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। ভাইস চ্যান্সেলর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।