সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের আধারে হাওরে ইজারাকৃত বিল ও জলমহাল শুকিয়ে মাছ মারা হচ্ছে। পানি শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় হাওরে ও বিলে মাছের প্রজনন ও বংশ একেবারে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বর্ষা মাসে হাওরে মাছের তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা। বিলে মানা হচ্ছে না জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা। স্যালু মেশিন দিয়ে অবাধে মাছ ধরায় মাছের বংশ ও প্রজনন সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
হাওরে ও বিলে যেখানে অভয়াশ্রম তৈরী করে মা মাছ ও মাছের আকার ও সংখ্যা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করার কথা সেখানে সেসবের উল্টোটা করা হচ্ছে। ইজারাদারেরা মুখে মুখে ঠিকই বলে আসছে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জলমহাল খনন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে জলমহাল খননের নামে মাছের বংশ ধ্বংস করা হচ্ছে। অধিকাংশ বিল ভরাট হওয়ায় ও মাছের প্রজনন ও রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে না করার ফলে দেশীয় মাছের উৎপাদনের হার একেবারেই কমে আসছে। তার পেছনে দায়ী হলো অতি লোভী ইজারাদারেরা। অতি মুনাফা পাওয়ার আশায় বিল শুকিয়ে মাছের এমন ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে।
মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, শাল্লায় ছোট-বড় ৯৯টি জলমহাল। ভূমি অফিসে একটি রেজিস্টারের মাধ্যমে ২০ একরের উর্ধ্বের জলমহাল বিভিন্ন মেয়াদে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়ে থাকে। ২০ একর এর নিচের জলমহাল স্থানীয়ভাবে দেওয়া হয়ে থাকে।
জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় যেসব জলমহাল রয়েছে-সেইগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবী সমিতি। ইজারা নীতিমালায় জলমহালে ৪-৫ ফুট পানি রেখে মৎস্য আহরণ করার কথা থাকলেও সেটি তিল পরিমাণও মানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ জলমহাল সেচ দিয়ে প্রতি বছর মৎস্য আহরণ করেন মৎস্যজীবিদের আড়ালে থাকা প্রভাবশালী একটি চক্র। জলমহালে মা মাছ সংরক্ষণ ও মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য অভয়াশ্রম তৈরীর বাধ্যবাধকতা থাকলেও এটি কেবল কাগজে কলমেই লিপিবদ্ধ।
বাস্তবে জলমহালের প্রতিটা বিল ও জলমহাল নির্বিচারে শুকিয়ে মাছ মারা হচ্ছে। ভরাট হওয়া বিল বা কোন জলমহাল খনন স্কিমে থাকলেও সেটিও মানা হচ্ছে না। নীতিমালায় জলমহালের আওতাধীন কৃষি জমিতে কৃষকদের সেচের সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও অসময়ে বিল শুকিয়ে ফেলায় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ কৃষকেরা। তাছাড়া ইজারা নির্ধারিত জলাশয়ের কয়েকগুণ ভোগদখল করায় মৎস্য আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ জেলে সম্প্রদায়ও। স্থানীয় প্রভাব কাটিয়ে জলমহালের নির্ধারিত এরিয়া পেরিয়েও স্থানীয় জেলেদের উপর প্রভাব কাটানোর অভিযোগও রয়েছে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, জলমহাল ইজারা নেয়া মৎস্যজীবী সমিতির নেপথ্যে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের অদৃশ্য হাত। তারা মৎস্যজীবী সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে জলমহাল ইজারা বাগিয়ে নিয়ে অবৈধভাবে জলমহাল শাসন ও শোষণ করায় ঘটছে নানাধরণের ঘটনা।
তেমনি একটি জলমহাল হবিবপুর ইউনিয়নের অন্তগত চাঞ্চাতল গ্রুপ জলমহাল। এই জলমহালের এরিয়া অত্র ইউনিয়নের সরসপুর গ্রামের নিকট কালনী নদী থেকে ফয়েজুল্লাহপুর হয়ে ভরাউট গ্রামের (ডোয়ার) হয়ে শরালীতোফা পর্যন্ত। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে মৎস্যজীবি সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে এটি ভোগ করে খাচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালী সাবেক ইউপি সদস্য এলাছ মিয়া, পিকলু মজুমদার, রমজুদ মাষ্টার গংরা। এই জলমহালটির একটি অংশ দিনেদুপুরে শুকিয়ে ফেলেন তারা। মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাসুদ জামান সরেজমিনে সেখানে গিয়ে নিষেধ দিলেও রাতের আধারে বিলটি শুকিয়ে মাছ ধরে ফেলেন এই চক্রটি। এ বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মার্কুলি গ্রামের পরশ মিয়া।
যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন এলাছ মিয়া গংরা স্থানীয় প্রভাব দেখিয়ে এই বিলটি শুকিয়ে ফেলেন। এই বিলটি না শুকালে স্থানীয় কৃষকের অনেক উপকার হতো। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন- অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি। প্রভাব কাটিয়ে তারা বিল শুকিয়ে মাছ ঠিকই ধরে ফেলেছেন।
মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাসুদ জামান বলেন, স্থানীয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করা দরকার, যারা জলমহাল ইজারা নিয়ে জলমহালের নীতিমালা লঙ্ঘন করে তাদেরকে যাতে ভবিষ্যতে ইজারা না দেওয়া হয়।
তার অফিসে লোকবলের সংকট উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরিয়া অনেক বড় হওয়ায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও একটি মেশিন জব্দ করে আনা সম্ভব হয় না। জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরার বিষয়ে স্থানীয়রাও বাঁধা নিষেধ করতে হবে বলে জানান তিনি।