শান্তিগঞ্জে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, অপসারণের দাবি

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বীরগাঁও ইমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই বিদ্যাপীঠটি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে একেবারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তৃণমূল পর্যায়ে। অর্ধশত বছর ধরে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার আলো বিলি করা এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখন সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। ঘোর অমানিশায় যেন ঢেকে আছে বিদ্যালয়ের এযাবৎ কালের যত অর্জন। ইদানিং ইউনিয়নের ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়ার বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। ইউনিয়নের সচেতন নাগরিকবৃন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিষয়ে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

প্রধান শিক্ষকের উপর আনিত এমন গুরুতর অভিযোগ এখন বীরগাঁও ইউনিয়নের মুখরোচক ঘটনা। ইউনিয়নের হাট-বাজার, বৈকালিক আড্ডায় কিংবা চায়ের টেবিলে এখন একটাই আলোচনা। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের এই বিষয়টিকে বলা যেতে পারে ‘টক অব দ্য ইউনিয়ন’।

এ নিয়ে বীরগাঁও গ্রামে একটি বিচার শালিশও বসেছে। প্রকাশ্যে না হলেও প্রধান শিক্ষকের হয়ে অপর একটি পক্ষ কাজ করছেন চলমান এই পরিস্থিতিকে গোপনে বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে শেষ করার। অনেকে আবার এই পদ্ধতিকে সমর্থনও করছেন। তারা চাইছেন, যদি প্রধান শিক্ষকের কোনো ভুল-ভ্রান্তি থেকেও থাকে তাহলে গোপনে বিচার করে তাকে আরেকটি সুযোগ দেওয়া দরকার। অভিযোগকারীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বীরগাঁও স্কুলটিকে লুটেপুটে খাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়া। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘অভিনব জালিয়াতি : কেরানী থেকে প্রধান শিক্ষক’ শিরোনামে তার বিরুদ্ধে সংবাদ হয়েছে। তখন তিনি শুধরান নি। তিনি আর শুধরাবেনও না। এমনসব অভিযোগ এনে প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়ার অব্যাহতি চান অভিযোগকারীরা।

প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার বিকেলে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বরাবর একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন বীরগাঁও ইউনিয়নের সচেতন নাগরিকবৃন্দ।

সকলের পক্ষে অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেন আজমল আহমদ। অভিযোগ পত্রের অনুলিপি ঢাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যালয়, সিলেটে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সিলেট অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয়, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সুনামগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে পারফর্মেন্স বেজড্ গ্রান্টস্ ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিশন (পিবিজিএসআই)-এর আওতায় পাঁচটি খাতে ব্যয় করার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা পায় বীরগাঁও ইমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। যে টাকা ইএফটির মাধ্যমে গত বছরের ১৮ জুন তারিখে প্রতিষ্ঠানের নামাঙ্কিত সোনালী ব্যাংকের একাউন্টে জমা হয়৷ প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষকদের মধ্যে ১ লক্ষ টাকা বিলি বন্টন ছাড়া বাকী চার লক্ষ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। যদিও তিনি বিভিন্ন খাতে এই টাকা বন্টন করেছেন বলে দাবি করেছেন কিন্তু এলাকার সচেতন মহল খরচের খাত, তার সঠিক প্রমাণাদি দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে দরখাস্তকারীদের। অভিযোগ পত্রে তারা আরো উল্লেখ করেন, বিধি মোতাবেক সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উল্লিখিত টাকা খরচের হিসাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সঠিক সময়ে তা উপস্থাপন করেননি প্রধান শিক্ষক। একাধিকবার তাগিদ দেওয়ার পর যেসব বিল-ভাউচার ব্যবহার করে তিনি এসব টাকা খরচ করেছেন বলে দেখিয়েছেন তা-ও একেবারে জাল এবং ভূয়া বলে দাবি করেছেন তারা।

অভিযোগপত্রে তারা আরও বলেন, বীরগাঁও গ্রামের পঞ্চায়েত মুরব্বিদের পরামর্শে চলতি মাসের ১২ তারিখ একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিলো। সেখানে সকলের উপস্থিতিতে পাঁচ লক্ষ টাকার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব চাইলে শিক্ষকগণের জন্য বরাদ্দকৃত ১ লক্ষ টাকার হিসাব দেন তিনি। বাকী চার লক্ষ টাকার সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেননি আজিজ মিয়া। এসময় উপস্থিত জনতা কিছুটা ক্ষুব্ধ হলে টাকা আত্মসাত করার বিষয়টি স্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক। তিনি এ টাকা ফিরিয়ে দিবেন বলে অভিযোগ পত্রে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সকল প্রকার ফি-তে বেশি টাকা আদায়, স্কুলের টাকা ব্যাংকের একাউন্টে জমা না রেখে নিজের পকেটে রেখে সুদের ব্যবসা করা, স্কুলে যথাযত দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করায় এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয়ের অভিযোগসহ ও চাকুরিতে যোগদানের পর থেকে চলতি সময় পর্যন্ত আজিজ মিয়া কর্তৃক প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা আত্মসাত হয়েছে বলে অভিযোগ পত্রে দাবি করেছেন অভিযোগকারীরা। বীরগাঁও ইমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন, জ্ঞানার্জনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান আবেদনকারীরা।

আবেদনকারী আজমল আহমদ, তার সহযোগি মিজানুর রহমান মাহিন ও সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়ার উপর আমাদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ বা আক্রোশ নেই। তার পেশাকে আমরা সম্মান করি। বীরগাঁও গ্রামের কেউ তাকে কিছুই বলবে না এটা আমরা নিশ্চিত করতে পারি। শিক্ষক হিসেবে তার সাথে কেউ বেয়াদবি করবে না। আমরা চাই, শিক্ষক আজিজ মিয়া তার প্রাপ্য সম্মান পান কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্থ আজিজ মিয়ার শাস্তি হোক। তারা বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে খোঁজখবর নিয়েছি তাতে প্রমাণিত হয় যে তিনি আপাদমস্তক একজন দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষ৷ গ্রামের পঞ্চায়েতের সভায় টাকা আত্মসাৎ করার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে স্বীকারও করেছেন তিনি। এই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। স্কুলের সকল বিষয়ে তিনি দুর্নীতি করেছেন। সব মিলিয়ে স্বপদে বহাল থাকার সকল নীতিগত অবস্থান তিনি হারিয়েছেন। তার প্রায় সব দুর্নীতিই প্রামাণিত। আমরা চাই, যে প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা নীতিনৈতিকতার শিক্ষা নিয়ে যাবে সেখানে এমন দুর্নীতিগ্রস্থ একজন শিক্ষক থাকতে পারেন না। প্রশাসনের কাছে আমরা ন্যায় বিচার চাই।

পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল বাসির ও রাজনীতিবিদ ছলিব নূর বাচ্চু বলেন, ‘২০১৭ সালে কেরানী পদ থেকে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন আবদুল আজিজ। তার নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক আছে। তিনি একাধিক দুর্নীতির সাথে জড়িত। টেস্ট পরীক্ষা, রেজিস্ট্রেশন ফি ইত্যাদিতে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন এই প্রধান শিক্ষক। আমরা চাই, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

অভিযোগের ব্যপারে প্রধান শিক্ষক আজিজ মিয়া বলেন, যারা অভিযোগ করেছেন তারা আমার ও সাবেক সভাপতির উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এই কাজটি করছেন। মূলত, আমার উপর আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, ‘বীরগাঁও ইমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। বিষয়টি অতিব গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। তদন্ত চলমান। চদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’