শহীদ স্মৃতি উদ্যান : অসাম্প্রদায়িক বাংলার পাঠ

সিলেট ক্যাডেট কলেজের পূর্ব পাশের টিলায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান’ নামের এক অনন্য উদ্যান নির্মিত হয়েছে। যেখানে রয়েছে ৬৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামাঙ্কিত সমাধিলিপি বা নামফলক। গত ৪ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখে এই শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করা হয়।

এই উদ্যানে স্থাপিত ‘নামফলক’ বা ‘সমাধিলিপি’ দেখলে ভাবনার জগত আলোড়িত হয়। শিহরিত হতে হয় বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যার ব্যাপকতা দেখে।

মুক্তিযুদ্ধ আসলে এদেশের সকল শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেয়ার যুদ্ধ ছিল। কেউ নয় মাসে সর্বস্বান্ত হয়েছে, কেউ হয়নি। তবে এ যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হলে সব পরিবারকেই সর্বস্ব হারাতে হতো। সবাইকেই হতে হতো শহীদ পরিবারের সন্তান। পাক হানাদার বাহিনী এ দেশের মুক্তিকামী সব মানুষকেই হত্যা করতে চেয়েছে। তাই নয় মাসে দেশজুড়ে শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লক্ষ মানুষ।


এখানে কর্নেল সাহেবের পাশে সৈনিক, চা বাগানের ম্যানেজার সাহেবের পাশে চা-শ্রমিক, হাজি সাহেবের পাশে ভট্টাচার্য্য মশাই, চক্রবর্তীর পাশে নমঃশুদ্র। এখানে হিন্দুর পাশে মুসলিম, বাঙালির পাশে মনিপুরি, পাত্র, উড়াং জাতিগোষ্ঠির মানুষের সমাধি। এই সমাধি প্রাঙ্গনে দাঁড়ালে উপলব্ধি করা যায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাকে। উদ্যানের প্রতিটি সমাধিতে একই মর্যাদার এপিটাফ। সকলের এক পরিচয়; শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি।


অনেকে বলেন, ‘ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতা।’ সিলেটের শহীদ স্মৃতি উদ্যানে দাঁড়ালে বোঝা যায় শুধু বাঙালির নয়, পাত্র, মনিপুরী, উড়াং জাতিগোষ্ঠির মানুষের রক্তে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। এ দেশের সকল জাতিস্বত্তার মানুষকেই প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতার জন্য। আর এ কথাটি ভালো করে উপলব্ধি হয় এই স্মৃতি উদ্যানে পা রাখলে।

এ স্মৃতি উদ্যান স্থাপত্য শৈলীর জন্য নয়, এখানে শায়িত বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষের এক অনন্য উদ্যান। একেকটি সমাধি এ উদ্যানের বৈচিত্র্যময় একেকটি পুষ্প বৃক্ষ। এখানে কর্নেল সাহেবের পাশে সৈনিক, চা বাগানের ম্যানেজার সাহেবের পাশে চা-শ্রমিক, হাজি সাহেবের পাশে ভট্টাচার্য্য মশাই, চক্রবর্তীর পাশে নমঃশুদ্র। এখানে হিন্দুর পাশে মুসলিম, বাঙালির পাশে মনিপুরি, পাত্র, উড়াং জাতিগোষ্ঠির মানুষের সমাধি। এই সমাধি প্রাঙ্গনে দাঁড়ালে উপলব্ধি করা যায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাকে। উদ্যানের প্রতিটি সমাধিতে একই মর্যাদার এপিটাফ। সকলের এক পরিচয়; শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি।

স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের অসংখ্য মানুষকে নির্মম নির্যাতনে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী। ঘর থেকে তুলে নিয়ে গেছে বুদ্ধিজীবীকে, মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেছে শ্রমিক বা ছাত্রকে। রাজাকার আল-বদরেরা বাবার বুক থেকে টেনেহিচড়ে তুলে নিয়ে গেছে কিশোরী বা তরুণীকে। রাজনীতির সাথে যুক্ত মুক্তিকামী অগ্রসর চিন্তার মানুষদের আটক করেছে। বন্দিশালায় আটকে রেখেছে দিনের পর দিন। অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে দিনের পর দিন আটক সববয়সী নারীদের উপরে।

অল্প কিছু মানুষ এদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও অধিকাংশ কেই শেষতক হত্যা করা হয়েছে। এই বর্বরেরা হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; চরম অবজ্ঞায় উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখে শহীদদের লাশ। শহীদদের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়- এ স্থানগুলো। যা ‘বধ্যভূমি’ হিসাবে পরিচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোট কতগুলি স্থান বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেই সংক্রান্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যায় না; তবে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এদেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করেছে। এমন একটি বধ্যভূমি হচ্ছে তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের বন্দিশালা (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ) সংলগ্ন বধ্যভূমি।

সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছেই বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এই টিলাভূমি, ছিল না কোন স্মৃতিচিহ্নও। সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না।

অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে অনন্য এই শহীদ স্মৃতি উদ্যান। গত ৪ঠা মার্চ ২০২৩ ইং শনিবার এই উদ্যানের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ স্বজনেরা। এই শহীদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণে মূল ভূমিকা রেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক।

‘সালুটিকর বধ্যভূমি’ নামে তালিকাভুক্ত লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা এই বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গবেষণাপত্রের বরাতে পাওয়া তথ্যে এবং গণমাধ্যমে দেয়া বিজ্ঞাপনের সূত্রে এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে ৬৬ জন শহীদের নাম ও ঠিকানা। গবেষকদের ধারণা এখানে আরো বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপাতত খুঁজে পাওয়া ৬৬ জন শহীদের নাম ও ঠিকানা লেখা সমাধিলিপি দিয়ে সাজানো হয়েছে এই বধ্যভূমি প্রাঙ্গণ। নামকরণ করা হয়েছে “বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান”।

এই উদ্যান নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ-এর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলি ৩০ লাখ শহীদ, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা দেখাতে পারি না। দেশব্যাপী তালিকা করা প্রায় সহস্রাধিক বধ্যভুমিতেই হয়তো হত্যা করা হয়েছে দশ লক্ষ মানুষ। এই বধ্যভূমিতেও নয় মাসে হত্যা করা হয়েছে শত শত মানুষ। অর্ধ শতাব্দী পর অনুসন্ধান করে মাত্র ৬৬ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। এ কাজে আমাদের সহযোগীতা করেছে এই প্রজন্মের সন্তান- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক এই বধ্যভূমির নাম স্মৃতি উদ্যান রাখার প্রসঙ্গে বলেন, এই স্মৃতি উদ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা যায়- এই মাটি সৈয়দ, চৌধুরী, ভট্টাচার্য্য, দত্ত, নমঃশূদ্র, হাজি, বণিক, মেজর, ক্যাপ্টেন, শিক্ষক, চিকিৎসক, ছাত্র, শ্রমিক সবার রক্তে রঞ্জিত। যা শহিদমিনার বা স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রজন্মের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা চাই- এই প্রজন্মের সন্তানেরা প্রতিটি সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করুক মুক্তিযুদ্ধকে ও গণহত্যার ভয়াবহতাকে।”

এই স্মৃতি উদ্যান থেকে ফিরে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষক হাসান মোরশেদ নিজের ফেইসবুক পেইজে লিখেন, ‘…আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে মুক্তিযুদ্ধে চেতনা কী? বলবো- এই উত্তর লেখা রয়েছে আমাদের বধ্যভূমিগুলোতে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিগুলোতে। সালুটিকর, বাঁশতলা, ডলুরা, কুল্লাপাথর যান- নামগুলো পড়েন, শহীদদের পরিচিতিগুলো জানেন। অভিজাত শ্রেণির মানুষ ছিলেন, ছিলেন প্রান্তিক জন, ছিলেন মুসলমান, ছিলেন হিন্দু, ছিলেন অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা। লে. কর্ণেল জিয়াউর রহমানের পাশেই শুয়ে আছেন ভাদুয়া উড়াং, আছেন পাত্র, আছেন মনিপুরী জনগোষ্ঠির মানুষ। আমরা তাঁদের সকলকে, প্রত্যেককে শহীদ হিসাবে সম্মান করি। সর্ব্বোচ্চ সমান। শহীদদের সম্মানে কোন শ্রেণি বিভাজন, ধর্ম বিভাজন থাকে না। তাঁরা সকলে মিলে সর্ব্বোচ্চ দান করেছিলেন উত্তর প্রজন্মের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে। তাঁরা সফল। মুক্তিযুদ্ধ তাই বৃথা নয়, মুক্তিযুদ্ধ কোন বেহাত বিপ্লব নয়।’

‘তাঁদের ত্যাগে জন্ম দেয়া রাষ্ট্র আমরা কীভাবে সাজাতে পেরেছি, সেই সক্ষমতার জবাব আমাদেরকে দিতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।’

  • আব্দুল করিম কিম। লেখক ও সংগঠক।