গেলো শুক্রবার ঢাকার ধামরাইয়ে ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রীর বাল্যবিয়ের ব্যবস্থা করেন অভিভাবকরা। খবর পেয়ে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বিয়েটি ঠেকান। তিনি মেয়ের বাবাকে ৩০ হাজার ও ছেলের বাবাকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। একইসঙ্গে বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা আর মেয়েটির বিয়ের চেষ্টা করবেন না বলেও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
রাজশাহীর গোদাগাড়িতে চার বছর আগে বিয়ে হয় বর্তমানে ২০ বছর বয়সী সিতারার (ছদ্মনাম)। বিয়ের দুই বছর পর ১৮ বছর বয়সে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু ১৬ বছর বয়সে যখন বিয়ে হয়, তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার কোনও কাবিননামা করা হয়নি। পরে কাবিননামা বের করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন সিতারার বাবা। মেয়েটির যে বিয়ে হয়েছিল, এখন সেটা প্রমাণ করাই কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিচ্ছেদের পরে স্বামীর কাছ থেকে যে অধিকার প্রাপ্তির আইনি বিধান, তা তারা আদায় করতে পারেননি।
লুকিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে এরকম একাধিক ঘটনায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। তারপরেও সাময়িক দায়িত্ব শেষ করার আগ্রহ থেকে মেয়েশিশুর বিয়ে দেওয়ার হার কমছে না। আইনজীবী ও সমাজ গবেষকরা বলছেন, যে কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা, সেটা যে প্রত্যেকের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে—সেই বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি প্রচারণা চালানো দরকার। এরকম পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে মেয়েশিশুর অধিকারের দিবস।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছরের ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক মেয়েশিশু দিবস। সাধারণত বাল্যবিবাহ নিরোধ, পুষ্টি, শিক্ষায় মেয়ে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতেই দিবসটিতে নানা পর্যবেক্ষণের বিষয় সম্পৃক্ত থাকে। এদিকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশুসপ্তাহ পালন করা হয়। এই শিশুসপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর একটি জরিপ বলছে, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির দুই বছরে ১৫-১৯ বছর বয়সী যে ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম বছর (২০২০) বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশের ও দ্বিতীয় বছর (২০২১) বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০১৯ অনুসারে, একই বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর ১৮ বছর বয়সের নিচে এই হার ৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিচালক (লিগ্যাল) অ্যাডভোকেট দিল সেতারা চুনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সবচেয়ে জরুরি দরকার আইনের প্রয়োগ। আইন আছে বাস্তবায়ন নেই। আমরা প্রতিনিয়ত এমন অনেক কেস দেখছি, যেখানে মেয়ের অভিভাবকরা নিজেদের ভুলের কারণে মেয়েসহ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের কাছে বিয়ের কোনও বৈধ কাগজ না থাকায়—ছেলের পরিবার মেয়ের প্রাথমিক যে অধিকার, সেগুলোও নিশ্চিত করতে পারেন না। যখন ভুল বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
বাল্যবিবাহ খারাপ জেনেও কেন তা কমানো সম্ভব হচ্ছে না, প্রশ্নে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক ও শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘‘সাধারণ পরিস্থিতিতে যখন আমরা বাল্যবিবাহের কারণ খুঁজি তখন—দারিদ্র্য, অসচেতনতা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বের মধ্যে নিয়ে আসি। এগুলো সত্য কিন্তু সমসাময়িক কারণ। এটা তো সত্য বাবা-মা তার সন্তানের ভালো চান। তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন বাল্যবিবাহ দিয়ে তাদের শৈশবটা নষ্ট করছেন? আসলে আমাদের দেশের মেয়েশিশুর জীবনের লক্ষ্য কী? হাতে গোনা দু-একটা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য তৈরি করতে পারিনি। ফলে মেয়ের অভিভাবকরা অনেক ভালো একটা বিয়ে দিয়ে একটা ‘স্থায়ী শ্বশুরবাড়ি’ নিশ্চিত করতে পারাটাই তাদের কাজ মনে করেন। মেয়েটি যখন কৈশোরে যাচ্ছে, তখন যদি অভিভাবক মনে করেন—তার কোনও লক্ষ্য নির্দিষ্ট নেই, তখন মেয়েদের জন্য স্বপ্ন তৈরি করুন। মেয়েদের জন্য অপশন তৈরি করুন। বিয়ে এবং সংসারের বাইরে মেয়ের জন্য লক্ষ্য তৈরি করা সম্ভব—এই ভাবনা দৃঢ় হলে বাল্যবিয়ে কমবে।’’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন