তিন বছর আগে যুগলবন্দি জীবনের পথচলা শুরু করেছিলেন করিম ও শাম্মী দম্পতি। ষোল মাসের একটি ফুটফুটে সন্তানও ছিল তাদের। করিম অল্প বেতনে একটি ট্রাভেলসে এজেন্সীতে চাকরি করতেন। এই অল্প আয়েই ভালো চলছিল তাঁদের। সোমবার জিলহজ মাসের নফল রোজা রাখার উদ্দ্যেশে রাতে সেহরি খান স্বামী-স্ত্রী দুজনে। এরপর ফজরের নামাজ শেষে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। সেই ঘুম থেকেই চিরঘুমে চলে গেলেন করিম-শাম্মী দম্পতি। সঙ্গে নিয়ে গেলেন একমাত্র সন্তানকেও।
সোমবার (১১ জুন) সকাল ৭টায় টিলা ধসে মাটিচাপা পড়ে তাঁদের মৃত্যু হয়। স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র শিশু সন্তানের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকে স্তব্দ স্বজন-প্রতিবেশিরা। বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন করিম ও শাম্মীর বাবা ও মা। চোখের সামনে সন্তানদের এমন মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা।
করিম-শাম্মী দম্পতির বাড়ি সিলেট নগরীর চামেলিবাগ এলাকায়। করিমের পুরো নাম আগা করিম উদ্দিন (৩০)। তাঁর স্ত্রী শাম্মি আক্তার রুজি (২৪) একই এলাকার আগা আইয়ুব উদ্দিনের ছেলে। আগা তাদের বংশগত নামের একটি অংশ।
এ ঘটনায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছেন করিম উদ্দিনের মা ইয়াসমিন বেগম (৬৫), বড় ভাই আগা রহিম উদ্দিন (৩৮), তাঁর স্ত্রী তাহমিনা বেগম (৩০), মেয়ে তাহসিনা (১০), তাসনিয়া (৫) ও ৬ মাসের শিশু তাসকিয়া।
ছেলে ও পুত্রবধূর মৃত্যু কোনোভাবে মানতে পারছেন না করিম উদ্দিনের মা ইয়াসমিন বেগম। টিলা ধসে মাটি চাপায় তিনিও পড়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিকে হারিয়ে শোকে স্তব্দ ইয়াসমিন বেগমকে রাখা হয়েছে প্রতিবেশীর ঘরে। সেখানে তাঁকে জড়িয়ে বিলাপ করছিলেন স্বজনরা।
ইয়াসমিন বেগম বলেন, একই ছাদের মধ্যে তাঁর দুইছেলে (করিম ও রহিম) আলাদা সংসার করতেন। তিনি বড় ছেলে রহিম উদ্দিনের সঙ্গে থাকেন।আর ছোট ছেলে করিম উদ্দিন তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকতেন। ঘটনার আগে সকাল ৬টার দিকে তিনি ঘুম থেকে ওঠেন। এসময় করিম ও তাঁর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঘুমে ছিলেন। ঘরের বারান্দায় কিছু সময় হাঁটাহাটির পর তিনিও ফের শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় বিকট শব্দের পর সাঁ সাঁ কোনো কিছু ঘরের উপরে পড়ছিল বুঝতে পারেন তিনি। মুহুর্তের মধ্যে টিলা ধসে পড়ে পুরো ঘরের মধ্যে।
ইয়াসমিন বেগম বলেন, ছোট ছেলের কক্ষ ছিল ভেতরের দিকে। টিলা ধসে পড়ায় প্রথমে তাদের কক্ষের টিনসহ সবকিছু মাটির সাথে মিশে যায়। এসময় কিছুটা বুঝে ওঠায় বড় ছেলের স্ত্রী ও সন্তানরা এবং তিনি মাটির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো ভাবে ওঠে আসতে পারছিলেন না। পরে প্রতিবেশী ও স্থানীয়রা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। তবে বড় ছেলে গলা পর্যন্ত মাটি চাপায় আটকা পড়েন। স্থানীয়রা তাকেও অনেক চেষ্টা করে উদ্ধার করেন। কিন্তু ছোট ছেলে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঘুমে থাকায় তারা আর বেরিয়ে আসতে পারেননি।
তিনি বলেন, তাদের ঘর থেকে টিলার দুরত্ব অন্তত ১৫০ ফুট। এতো দুর থেকে ধসে পড়ে এভাবে মৃত্যু হবে তা কল্পনায়ও ছিলো না।
৬৫ বছর বয়সী ইয়াসমিন বেগম বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে একবার এই টিলা ধসে পড়েছিল। তখন একজন মারাও গেছেন। এরপর আর টিলায় একটি অংশও ধসে পড়ার মতো অবস্থা ছিলো না। আমরা নিরাপদে এখানে বসবাস করছি।
টিলা ধসে করিম-রহিমের পরিবার ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মাহমুদ মিয়া, বাবুল মিয়া, শফিক মিয়া ও শামিম উদ্দিনের ঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তারা কেউ হতাহত হননি।
শাম্মীর বাবা আগা আইয়ুব উদ্দিন বলেন, তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে শাম্মী দ্বিতীয়। ছোট মেয়ের বিয়ে শেষ হয়েছে। বড় মেয়ে সুমি আক্তার শিমুর আকদ সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামী ১২ তারিখে তাকে তুলে দেওয়ার কথা। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, গতকাল রোববার বিকেলে এসে মেয়ে ও নাতিকে দেখে গেছেন। তার মেয়ে খুবই ধার্মিক ছিলেন। জিলহজ মাসের সবকটি নফল রোজা রাখছিলেন। আজও সেহরি খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু টিলা ধসে এভাবে সবাইকে চলে যেতে হবে কে জানতো।
এর আগে সকাল ৭টার দিকে চামেলীবাগ এলাকায় টিলা ধসে মাটিচাপা পড়েন একই পরিবারের ৯জন। তাৎক্ষণিকভাবে ছয়জনকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ শেষ করতে না পারায় উদ্ধারকাজের সঙ্গে যুক্ত হয় সেনাবাহিনী। পরে সেনাবাহিনীর আড়াই ঘন্টার চেষ্ঠায় সাড়ে ছয়ঘন্টা পর মাটির নিচ থেকে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে মরদেহ তিনটি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিকেলে মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতালের পুলিশ বক্সের ইনচার্জ জাফর ইমাম।
উদ্ধার অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ফারুক আহমদ বলেন, টিলা ধসে চাপা পড়া একই পরিবারের তিনজন নিখোঁজের খবর পেয়ে সকাল ১১টার দিকে আমরা অভিযান শুরু করি। প্রথমদিকে আমাদের বিভিন্ন ইউনিট ঘটনাস্থলের চারপাশ পর্যবেক্ষন করে উদ্ধার কাজ শুরু করে। আড়াই ঘন্টা চেষ্টার পর তিনজনকে উদ্ধার করা হয়। পরে আমাদের মেডিকেল টিমের সদস্যরা চেকআপ করে নিশ্চিত করেন তাদের মৃত্যু হয়েছে।পরে মরদেহ তিনটি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সিলেট ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি দল উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।পরে দক্ষিণ সুরমা থেকে আরেকটি ইউনিট যুক্ত হয়। এরপর ১১টার দিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।সকলে প্রচেষ্ঠায় তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, টিলাটি অন্তত ৪০০ ফুট উচু হবে। এই টিলার পাদদেশে যারাই বসবাস করছেন, সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।