ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সংযোগকারী সেতুতে বিস্ফোরণের ঘটনার পর ইউক্রেনজুড়ে বড় ধরনের হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভসহ বড় শহরে গত দুইদিনে প্রায় একশ রুশ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো লক্ষ্য করে এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। পানি সরবরাহ ও ঘর গরম রাখার ব্যবস্থাও অচল হয়ে গেছে।
গত কয়েক মাসে রাশিয়ার দখল করা অনেক এলাকা থেকে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। এমন পরিস্থিতিতে, একদিকে তিন লাখ সৈন্যের রিজার্ভ তলব করেছে রাশিয়া, অপরদিকে ইউক্রেনকে আরও সামরিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার নতুন কৌশলগুলো কেমন হতে যাচ্ছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনজুড়ে এভাবে রাশিয়ার ব্যাপক হামলার ঘটনা গত কয়েক মাসে দেখা যায়নি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া প্রথম ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। শুরুর সেই সময়ে কিয়েভের আশেপাশের এলাকায় এ ধরনের হামলা চালানো হয়। এরপর আর এমন তীব্র হামলা দেখা য়ায়নি।
পরবর্তীতে কিয়েভ থেকে রাশিয়া সেনা প্রত্যাহারের পর মূলত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলো দখলে রাখতেই রাশিয়া মনোনিবেশ করে। কিন্তু ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়াকে সংযোগকারী সেতুতে বিস্ফোরণের ঘটনার পর রাশিয়া আবারও তীব্র হামলা শুরু করেছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই এসব হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ওই সেতুতে বিস্ফোরণের জন্য ইউক্রেনকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিশোধ হিসেবেই এসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক অবশ্য মনে করছেন ইউক্রেনজুড়ে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালেও রাশিয়া ইউক্রেনে পুরাদস্তুর সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা এখনো করছে না। রাশিয়া হয়তো ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করতে চাচ্ছেন।
কিন্তু গত ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ন্যাটোর ব্যাপক সমর্থনপুষ্ট হয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে রুশ বাহিনীকে অনেকটা হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। রাশিয়ার দখল থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকা ইউক্রেনীয় বাহিনী ফের পুনরুদ্ধার করে নেয়। ইউক্রেনের বড় সাফল্য হলো ক্রিমিয়াকে গাড়ি বোমা হামলা করে রুশ ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারা।
বিশ্লেষকদের মনে করছেন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলার মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনীয়দের শিক্ষা দিতে চায় যে যুদ্ধ এখানেই আপাতত তোমরা ঠেকিয়ে রাখো। বাড়াবাড়ি করলে পাল্টা আক্রমণ করার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য রাশিয়ার রয়েছে। ইউক্রেন ও ন্যাটোকে সেটা রাশিয়া পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে।
রিজার্ভ সৈন্যে কী লাভ হবে রাশিয়ার?
বলা হচ্ছে, রাশিয়া তাদের প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত সৈন্য ইউক্রেনে যুদ্ধে মোতায়েন করার পরেও যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য তিন লাখ রিজার্ভ সৈন্য তলব করেছে রাশিয়া।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিজার্ভ সৈন্য ডাকার অর্থ যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থা সুবিধাজনক নয়। সামরিক বিশ্লেষক মুরাত আসলান বলেন, একটি যুদ্ধে নিয়মিত সেনাবাহিনী সফল হলে রিজার্ভ সৈন্য তলব করার দরকার হয় না। রিজার্ভ সৈন্য ডাকা হয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়মিত সৈন্যদের ক্ষতি সাধন হয়।
অপরদিকে সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, রিজার্ভ সৈন্যদের কাছ থেকে যুদ্ধের সফলতা আশা করা হয়না। রিজার্ভ সৈন্যদের ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা এলাকাগুলো রক্ষায় ও দখল ধরে রাখতে ব্যবহার করা হবে। নিয়মিত বাহিনী পাঠানো হবে যুদ্ধ করার জন্য বা ইউক্রেনের বাহিনীকে হটিয়ে দেয়ার জন্য।
রাশিয়া কি আবার পুরাদস্তুর হামলা চালাচে যাচ্ছে?
ইউক্রেনে হামলা শুরুর সময় বিশেষ সামরিক অভিযান আখ্যা দিয়ে একে সীমিত সামরিক অভিযান বলে বর্ণনা করেছিল রাশিয়া। এখন তারা বুঝতে পারছে সেটা আর সীমিত সামরিক অভিযানের মধ্যে নেই। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে ন্যাটো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াগোয়েন্দা তথ্য দিয়ে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিয়েছে তারা।
সেই সঙ্গে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে দেশটির ওপর। রাশিয়ার সেনাদলও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর অর্থ রাশিয়া যেসব লক্ষ্য নিয়ে ইউক্রেনে সমরাভিযান শুরু করেছিল, তার অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া এখনো নিজেদের পুরোপুরি ক্ষমতা ব্যবহার করেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডারের ব্যবহার দেখা যায়নি। ইউক্রেনে রাশিয়া ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, কিন্তু এরপরেও এখনো রাশিয়া ইউক্রেনে তার বিমানবহর, নৌবহর, ক্ষেপণাস্ত্রবহর বা আধুনিক সামরিক অস্ত্র পুরোপুরি ব্যবহার করেনি। রাশিয়া কখনোই ইউক্রেন যুদ্ধকে একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ বলেনি। সেজন্য যে পরিমাণ সমর সামগ্রী, জনবল মোতায়েন করা দরকার, সেটাও তারা করেনি। বিমান ও নৌ হামলার ক্ষেত্রেও সীমিত শক্তি প্রয়োগ করেছে তারা।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, রুশ বাহিনীর মূল কিছু ইউনিট ও যে বিশাল বিমানবহর, নৌবহর বা ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা রয়েছে সেগুলো তারা ধরে রেখেছে ন্যাটোর সঙ্গে কোনো রকম সংঘাত বাধলে তখন সেগুলো ব্যবহার করার জন্য।
এদিকে ইউক্রেন বহুবার বলেছে তারা শান্তি আলোচনায় আগ্রহী তবে তার আগে দখল করা সব এলাকা রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে। রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনে দখল করা সব এলাকা ছাড়তে কখনো রাজি হবে না। বিশেষ করে দোনেৎস্ক, লুহানস্ক এবং ক্রিমিয়া তারা কখনোই ছাড়বে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা হামলার মুখে পূর্বাঞ্চলে বেশ বিপদে পড়েছে রুশ বাহিনী।
অপরদিকে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ইউক্রেন ও রাশিয়া জুড়ে প্রচন্ড শীত থাকবে। তীব্র শীত ও বরফ জমে থাকার কারণে তাপমাত্রা ব্যাপক মাত্রায় কমে যায়। তখন রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রকৃত যুদ্ধ ক্ষমতা দেখা যাবে। সেইসঙ্গে গোটা ইউরোপ জ্বালানি সংকটে পড়বে ও অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাশিয়া সেই সংকটের সুযোগ নিয়ে অবস্থান সুদৃঢ় করতে চেষ্টা করবে। বর্তমানে সেই উদ্দেশ্যেই রাশিয়া এগোচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।