বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটে। ‘জয় বাংলা’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর অনুকরণে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন এনে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এমনকি ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসন করা হয়। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। আরও হাজারও পরিবর্তন থেকেই বুঝতে সমস্যা হয় না—এ দেশের সব জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু, তার অবদান ও পরিকল্পনাকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে উদ্যত ছিল ঘাতকরা।
পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের বাংলাদেশে ফেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এরপর তিনি হাল ধরলেন, কোষাগারশূন্য যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা হবে প্রথম কাজ। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলেন, একটা অসাম্প্রদায়িক সংবিধান দিলেন, দেশ পুনর্গঠনে সকলকে আহ্বান জানালেন। শিল্প উৎপাদন প্রায় নেই, নেই কাঁচামাল বা খুচরা যন্ত্রাংশ; সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন চলতে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৮ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত আর কখনও অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন বাঙালি জাতির এই অবিসংবাদিত নেতা। সেই সঙ্গে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল এবং সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে। একই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকেসহ তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
‘জয় বাংলা‘র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’
জাতির পিতাকে হত্যার পরপরই ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানি কায়দায় উর্দু শব্দে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন করা হয়। ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়া হয়। ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসন করা হয়। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কয়েক দিন পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, এক্সট্রা অর্ডিনারি পাবলিশড বাই অথরিটি’ অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করেন খন্দকার মোশতাক। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
দেশবিরোধীদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা
৫ এপ্রিল ১৯৭৮, জেনারেল জিয়ার সরকার এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে। এর মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীরা এবং বিদেশে পালিয়ে থাকা আলবদর-রাজাকারদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া এই আমলেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করা হয়।
বদলে যায় পত্রিকার পাতা
সেসময় যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হতো তার প্রথম পৃষ্ঠায় আগে যেখানে প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধু বা তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের সংবাদ দেখা যেতো, ১৫ আগস্টের পর তা বদলে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি কোনও পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে আসেনি। কোনও কোনও খবরে নতুন সরকারের গুণগান করতেও দেখা যায়। এমনকি চাপা পড়ে যায় সেনা অভ্যুত্থান ও অবৈধ ক্ষমতা দখলের খবরও।
সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান
হত্যাকাণ্ডের পর এক-এক করে রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয়, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার বিভিন্ন অঙ্গগুলোকে আমূলে বদলে ফেলতে থাকে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার অনুচরেরা। বঙ্গবন্ধুর নাম বা মুক্তিযুদ্ধর কোনও প্রামাণ্য যেন না থাকে, সেই উদ্যোগও নিতে পিছপা হয়নি সেদিনের সেই ষড়যন্ত্রকারী সরকার। প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই আটক করা হয় তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির ২৬ জন নেতাকে। আর সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান।
বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠন
সরকার সমগ্র বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠন করে। এক সরকারি হ্যান্ডআউটের বরাত দিয়ে বলা হয়, সরকার ১৯৭৫ সালের সামরিক আইন বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই সামরিক আইন-আদালত গঠন করেছে। এদিকে ২৮ আগস্ট প্রস্তাবিত ৬১ জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৭৫ সালের জেলা প্রশাসন আইনটিও একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাতিল করা হয়। এর ফলে গভর্নর, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিয়ম এবং প্রস্তাবিত জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বাতিল হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন