যোগ বিয়োগের দিনপঞ্জি

নিশ্চিত করে বলা যায় দেশে দুর্ভিক্ষ নেই, মঙ্গা নেই… কিন্ত আপামর জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বিচারে দ্রব্যমূল্য অনেক বেশি। ধনী এবং গরীবের আয় কিংবা সঞ্চিত সম্পদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে, কেন হয়েছে তা অর্থনীতিবিদদের গবেষণার বিষয়। দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে নিন্ম আয়ের মানুষের রোজগার বাড়েনি। উপরন্তু মানুষের ডাল ভাতের বাইরেও চাহিদা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। আগে যেখানে পেটভরে ভাত খেলেই মানুষ সন্তুষ্ট থাকতো, সেখানে অনেক নতুন উপকরণ যুক্ত হয়েছে, সময়ের সাথে, জীবনযাপনের প্রয়োজনে।

উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত কোন পরিবারের বিদ্যুৎ বিলই প্রতি মাসে যা আসে, প্রায় একই অর্থে সারা মাস পুরো পরিবারকে চলতে হয় পাশের বস্তিতে।

আমাদের অনেকের সন্তানের স্কুল এবং টিউটর বাবদ যা খরচ হয় তা কত লক্ষ পরিবারের সারামাসের আয়ের চেয়েও বেশি। আশির দশকে যারা স্কুলে গিয়েছি, আমাদের শৈশবে পাশের বস্তিতে থাকা কোন পরিবারের সন্তানের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ এবং আমাদের জন্য ব্যয়ের পরিমাণে এতো বিরাট ফারাক ছিল না যতটা আমার বা আপনার সন্তানের সাথে আছে।

নিঃসন্দেহে বলা যায় দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং নৈরাজ্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। আগে সবাই জানতো কোন অফিসে কে ঘুষ খায়, এখন অফিসে অফিসে খুঁজেও ঘুষ খায় না এমন লোক বের করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। যে কোন উপায়ে ‘বড়লোক হতে হবে’ এমন মানসিকতা ‘মানসিক রোগ’ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ চোখের সামনে সবাই দেখছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে কিভাবে কিছুলোক রাতারাতি মাটি থেকে মহাশূন্য ছুয়ে যাচ্ছে।

আমার মত অনেকেই আছে যারা নিরাপদ অবস্থানে থেকে সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিশীল সমালোচনা করি, তারা মূলত সুবিধা ভোগী, আমাদেরও মহাশূন্যের ভাসার শখ, শুধু সুযোগের অভাবে পারি না।

কলামের এই অংশের সাথে দ্বিমত করলে আমি ভেবে নেবো আপনি নেহায়েত ভাল মানুষ।

একটি ঘটনা দিয়ে কলাম শেষ করি। কয়েক মাস আগে আমি বস্তিতে শরিফার ঘরে গিয়েছিলাম। সে আমার খুব কাছের মানুষ। সে ছাগল খাসি পালন করে। তার সাথে আমার খাসি ক্রয়বিক্রয় বিষয়ে ক্ষুদ্র একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে। তো বস্তিতে গিয়ে দেখি সে বাইরে রান্নার চুলায় মাছ ভাজছে। খেয়াল করে দেখি তেল না দেয়ার কারণে সেই মাছ হাড়ি থেকে উল্টাতে পারছে না। জিজ্ঞাস করলাম, তেল ছাড়া মাছ ভাজা হয় কিভাবে রে?
উত্তরে সে জানালো, রান্না করার জন্য কিছু তেল ঘরে আছে, কিন্তু সেই তেল মাছ ভাজার জন্য খরচ করা যাবে না। যে তেল দিয়ে মাছ ভাজা হবে, সে তেলে সপ্তাহের দুই তিন দিনের রান্না হয়ে যাবে। ছেলে মৎস্য অফিসের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনেছে, শখ করেছে ভাজা খাবে। তাই তেল ছাড়াই মাছ ভাজা চলছে।

আমরা একটা ব্যাপার খেয়াল করি, শরিফার ঘরে তেল, মাছ, ডাল, ভাতের ব্যবস্থা কোন মতে ঠিকই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাছ ভাজার জন্য কতটুকু তেল লাগবে… আর সেই তেলে তার সপ্তাহের কতদিনের রান্না হয়ে যাবে সেই হিসাব শরিফাকে করে চলতে হয়। এটা শরিফার হাজারো নিত্যনৈমিত্তিক মানিয়ে নেয়ার মত সমস্যার মত একটি ‘সহজ’ সমাধান যোগ্য, যোগ বিয়োগের সমস্যা। আজ এটা যোগ করতে হলে ওটা বিয়োগ করা লাগবে। কাল আরেকটা….।

আমরা সুবিধাজনক স্থান থেকে এই সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারি। ভাবা শেষ হলে হালকা আঁছে সর্ষে ইলিশ ভাজা বৃষ্টির দিনে খেতে পারি। দিনের আবহাওয়ার উপর খাবার মেন্যু চেঞ্জ করা যেতেই পারে। খাওয়া শেষ হলে আমরা ভাবতে বসবো, হিরো আলম এবং রুচির দুর্ভিক্ষ বিষয়ক কলাম নিয়ে।

  • এনামুল হক এনাম। চিকিৎসক ও কলামিস্ট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhetvoice.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করবে না।