মৌলভীবাজারে ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগের হানা

‘মহাজন আমাদের এনে নিজেই বিপদে পড়লেন। এবারের আগাম জাতের বেশিরভাগ ধান ঘরে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’ আক্ষেপের সুরে এমন কথা বলছিলেন ধান কাটতে আসা শ্রমিক পরেশ কর্মকার।

তিনি বলেন, ‘ধানে চিটা হয়ে গেছে। প্রায় জমিতে একই অবস্থা। এখন আমাদের মজুরিটাও মহাজনের উপরেই পড়বে।’

পরেশ কর্মকারের মতো অনেক শ্রমিক এসেছেন মৌলভীবাজারের কাউয়াদিঘির হাওরপাড়ে। আগাম জাতের ধান কেটে কৃষকের ঘরে তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যখন ফসলের মাঠ সোনালি রঙে পূর্ণতা পাচ্ছে, ঠিক তখনই মৌলভীবাজারের হাওরপাড়ে ব্রি-২৮ আগাম জাতের ধান চাষে কৃষকদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট আতঙ্ক। অনেক টাকা খরচ করে ফলানো সোনার সেই ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন মাঠেই হচ্ছে ভঙ্গ।

কৃষকরা বলছেন, তাদের অর্ধেকেরও বেশি ব্রি-২৮ জাতের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কৃষি বিভাগ জানায়, তারা মাঠ জরিপ করছেন ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন করতে।

কাউয়াদিঘির হাওর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবুজের বুকে সোনালি রঙের ধানগুলো জানান দিচ্ছে তার পরিপূর্ণতা। কিন্তু কাছে গেলেই চোখে পড়ে বেশিরভাগ ধানের মাথা হয়ে আছে সাদা; ভেতরে ফাঁকা।

এসময় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দশ বারো দিন ধরে ব্রি-২৮ আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। তারা এবার অর্ধেকেরও বেশি ব্রি-২৮ জাতের ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষাবাদের লক্ষমাত্রা ছিল ৫৬ হাজার ৮ শত ৫০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৫৭ হেক্টর। যেখানে হাওর এলাকায় ২৭ হাজার ৫ শত ৫৮ হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের আগাম ধানের চাষাবাদ হয়েছে।

জানা গেছে, হাওরাঞ্চলের কৃষক পরিবারগুলো বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। ভালো ফলন হলে মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে জীবনযাপন সুখকর হয়। ফলন খারাপ হলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়লে সারাবছর ধারদেনা করে চলতে হয়। হাওরপাড়ের মানুষের মূল আতঙ্ক হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যা। এসব দুর্যোগ এলে তাদের সোনালি স্বপ্ন পানিতে মিশে যায়। এ জন্য অনেক কৃষক তাদের নির্দিষ্ট জমির অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ আগাম জাতের ধান চাষাবাদ করেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ও খরার প্রভাবে ধানের ছড়ায় ধান কম, ধানে শীষ রোগ এবং ছড়ায় অধিকাংশ ধানে চিটা, সার নেই। ফলে প্রকৃতির দ্বিমুখী সংকটে পর্যাপ্ত ফসল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাওড়পাড়ের কৃষক পরিবারগুলো।

দিনমজুর সুজিত দাশ ও সীমান্ত দাশসহ ৯ জন শ্রমিক ধান কাটতে এসেছেন শ্রীমঙ্গলের ফুসকুড়ি চা-বাগান থেকে। তারা বলেন, মূল ধান পাকতে দেরি আছে। এখন যেগুলো কাটছি, এগুলো আগে পেকে যায়। মালিক পক্ষ আমাদের দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিচ্ছেন। ধানের যে অবস্থা আমাদের মজুরি দিতে মালিকের কষ্ট হবে।

আশা ছিল ভালো ফলন পাব, কিন্তু কপাল খারাপ জানিয়ে রায়পুর গ্রামের কৃষক মুজাহিদ মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ধারদেনা করে চার বিঘা জমির মধ্যে দেড় বিঘা ব্রি-২৮ ধান চাষ করেছিলাম। ধারণা ছিল ২৫ মণের ওপরে ফলন পাব। এখন সেখানে ৬ মণের বেশি ফলন পাব না।

এমন দূর্যোগ আসবে কল্পনা করতে পারেননি সদর উপজেলার রসুলপুর গ্রামের কৃষক ইকবাল মিয়া। তিনি বলেন, মাঠের প্রায় ৮০ ভাগ ধানে চিটা। ২০ ভাগ ভালো থাকলেও কাটানো খরচ উপরেই পড়বে। তাই অনেকে তা কাটার চিন্তা করছেন না। কেউ কেউ সেই ধান কেটে নিয়ে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। এপর্যন্ত আমার ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন এই ধান কেটে তো আমি খরচও তুলতে পারবো না।

প্রবীণ কৃষক সুষেন্দ নমঃশূদ্র জানান, প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা। প্রত্যাশা ছিল প্রতি বিঘায় ১৫ মণের ওপরে ধান পাওয়া যাবে। এখন মনে হচ্ছে ৩ থেকে ৪ মণ ধান মিলবে। আমাদের ধান সব নষ্ট হয় গেল। এখন খাবো কী? কৃষি বিভাগ একবারও আমাদের খোঁজ নেয়নি।

তারা পরামর্শ দিলে এমন ক্ষতি হতো না জানিয়ে জুমাপুর এলাকার আশিউর্ধ্ব কৃষক আবদুর রউফ বলেন, আমার ৭ একর জমির মধ্যে ৫ একর জমির ধান একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, বাকি ২ একর জমির ধান অর্ধেক পাবো কি সন্দেহ আছে।

হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ বলেন, ব্রি-২৮ জাতের ধান যারাই রোপণ করেছেন, তারাই আজ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গত দুই বছর ধরে ব্রি-২৮ ধান চাষ করে কৃষকরা মার খাচ্ছেন। এরপরও কেন এই ধানের বীজ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিক্রি করে তা বোধগম্য নয়। সেটা তদন্ত করে বের করতে হবে। এটা গরিব কৃষকের পেটে লাথি মারার শামিল। যারা শুধুমাত্র এই বোরো ফসলের উপর নির্ভর করে সংসারের সকল ব্যয় বহন করেন, গ্রাম ভিত্তিক তাদের একটি তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, যেভাবে কৃষকরা দাবি করছেন তা সঠিক নয়। আমাদের মাঠ থেকে প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ী ব্লাস্ট রোগে কিছু ধানের জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা শুরু হয়েছে। সরকারের কোনো বরাদ্দ বা প্রণোদনা এলে, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।