মৌলভীবাজারে শারদীয় দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ২৪ লাখ টাকার উৎকোচ আদায় করেছে একটি চক্র। এ চক্রের সঙ্গে মৌলভীবাজার আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ আনসার সদস্যরাও জড়িত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যেক আনসার সদস্যকে উৎকোচ দিয়ে ৬ দিনের চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। আবার একই ব্যক্তির নাম একাধিক পূজামণ্ডপে দেওয়া হয়েছে। অনেক পূজামণ্ডপে ৪ জন আনসার সদস্যকে নিয়োগ দিলেও দায়িত্ব পালন করছেন ১ জন। তালিকায় গড়মিল সৃষ্টি করার জন্য মোবাইল নম্বর ও নামে ইচ্ছাকৃত ভুল করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টদের এমন বাণিজ্যে ক্ষুব্ধ আনসার সদস্যরা।
জেলা আনসার ভিডিপির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর পুরো জেলায় ১ হাজার ৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। পূজামণ্ডপের গুরুত্ব অনুযায়ী ৮, ৬ ও ৪ জন করে পুরো জেলায় ৪ হাজার ৮২২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছয় দিনের চাকরিতে ঢোকার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়া হয়েছে ৭শ থেকে শুরু করে ৩শ টাকা পর্যন্ত। আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা চাকরি করার নিয়ম থাকলেও অনেক প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিকেও টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। আবার কারও দায়িত্ব এক পূজামণ্ডপে থাকলেও কাজ করছেন অন্য জায়গায়।
সরেজমিন মৌলভীবাজার পৌর শহরের চাঁদনীঘাট ব্রিজের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী পূজামণ্ডপে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য মো. ইমাদ মিয়া, সাহেদা ও সুবর্ণার সঙ্গে কথা হলে তারা টাকা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের কথা স্বীকার করেন। তারা ওই টাকা সদর উপজেলা আনসার অফিসের স্টাফ শিবলীর কাছে দিয়েছেন বলে প্রতিবেদককে জানান।
এ সময় এক আনসার সদস্য বলেন, ইমরান নামে এক আনসার সদস্য কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় তাকে চাকরি দেয়া হয়নি।
সেন্ট্রাল রোডের কালিবাড়ি মণ্ডপে দায়িত্ব পালনকারী দুলাল মিয়া, রফিক মিয়া এবং কাশীনাথ স্কুল মাঠের মণ্ডপে দায়িত্ব পালনকারী মো. সজল মিয়া বলেন, নারী নেত্রী হনুফা বেগমের স্বামী রুনু মিয়ার কাছে ৭০০ টাকা দিয়ে ৬ দিনের চাকরি নিয়েছি।
পৌর শহরের ক্লাব রোডের মণ্ডপে দায়িত্ব পালনকারী শ্রীমঙ্গল উপজেলার জমসেদ মিয়া বলেন, ৬ দিনের চাকরির জন্য শ্রীমঙ্গল উপজেলা আনসার ভিডিপি কার্যালয়ের বিউটি বেগমকে ৬০০ টাকা দিতে হয়েছে।
রাজনগর বাজার পূজামণ্ডপে দায়িত্বপালন করা আনসার সদস্য দেলোয়ার, রুশিয়ারা ও রাশিয়া বেগম বলেন, ৬ দিনের চাকরির জন্য ওয়াহিদ মিয়াকে ঘুষ দিতে হয়েছে।
ওই মণ্ডপে দায়িত্ব পালনকারী সুমন ও রাজন বলেন, ৬ দিনের কাজের জন্য আমাদেরকে ১৫০০ টাকা দেয়া হবে বলে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে আমাদের নামে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানি না।
এদিকে রাজনগর উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস এক আদেশে বলা হয়েছে সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামণ্ডপে এপিসি হিসেবে মো. ছাবুল মিয়া, সদস্য হিসেবে করুনা মালাকার, চায়না বেগম ও হাজেরা বেগম দায়িত্ব পালন করবেন।
তালিকায় নাম দেয়া চায়না বেগমের মোবাইল নম্বরে কল দিলে তার স্বামী মুহিত মিয়া কল রিসিভ করে জানান, চায়না ও হাজেরা কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা দুজনই চাকরির জন্য রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর গ্রামের আদরকে ৫০০ টাকা করে ঘুষ দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামণ্ডপে এপিসি হিসেবে ছাবুল মিয়ার সঙ্গে মাসুদ, সুরমা ও কামাল নামের ৩ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমন চিত্র পুরো জেলার।
একাধিক এপিসি ও আনসার সদস্য শারদীয় দুর্গাপূজার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার চাকরিতে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নির্বাচন এবং অন্যান্য ডিউটিতেও নাম ঢুকানোর জন্য অফিসে ঘুষ দিতে হয়।
রাজনগর উপজেলার এক ইউপি সদস্য বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসের স্টাফরা ৫০০ টাকা ঘুষ নিয়েছে এবং ৪ জনের জায়গায় ২ জন দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হয়েছে।
অন্য এক ইউপি সদস্য বলেন, আমার ওয়ার্ডের মণ্ডপে ৪ জনের জায়গায় ১ জন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হয়েছে।
জেলা আনসার ও ভিডিপির কমান্ড্যান্ড মো. সেফাউল হোসেন বলেন, আনসার সদস্যদের কাছ থেকে যারা ঘুষ আদায় করেছেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।